উনা মাতিনা মি সান জুয়েলিয়াতো,
ও বেলা চাও, বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও!
উনা মাতিনা মি সান জুয়েলিয়াতো,
এ ও ত্রোভাতো লিনভাজোর।
শব্দগুলো জট পাকচ্ছে তো? একটু ভাবুন, হালফিলে নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় স্প্যানিশ সিরিয়াল ‘লা কাসা দে পাপেল’ এ ব্যবহৃত হয়েছে এই গানটি। আর যারা আগে শোনেননি তাদের হয়তো গানটির সুর ছোঁবে। সুর তো সীমানা, দেশ, গন্ডি, ভাষা এসব মানে না। তবে এই ‘বেলা চাও’ গানটিকে পরতে পরতে ঘিরে রয়েছে ইতিহাসের ছোঁয়া। সে বিষয়ে একটু অবগত করার প্রচেষ্টা আর কি!
‘লা কাসা দে পাপেল’ এ এই গান ব্যবহৃত হয়েছে। ঐ সিরিয়ালে গানটি বেশ কয়েকবার ব্যবহৃত হয়েছে, যার মধ্যে দর্শকদের কাছে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে প্রথম সিজনের শেষ পর্বের একেবারে শেষ দৃশ্যে সিরিয়ালটির প্রধান দুই চরিত্র, দ্য প্রফেসর এবং বার্লিনের গলায় গাওয়া গানটি। কিন্তু বাস্তবে ‘বেলা চাও’ গানটির ইতিহাস আরও অনেক পুরানো।
বেলা চাও (Bella Ciao) যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, “বিদায় হে সুন্দরী”। আদতে এটি একটি ইতালিয়ান ফোক সঙ্গীত। কিন্তু এটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে ইতালির গৃহযুদ্ধের সময়। ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের সময়, বিশেষ করে ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত একইসাথে ফ্যাসিস্ট ইতালিয়ান সোশ্যাল রিপাবলিক এবং নাৎসি জার্মানদের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া সংঘবদ্ধ সশস্ত্র আন্দোলন পরিচিত হয় পার্টিজান আন্দোলন নামে। এই পার্টিজানদের মধ্যেই বেলা চাও গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
বেলা চাও (Bella Ciao) গানটি ইতালির সবচেয়ে বিখ্যাত গানগুলোর একটি। কিন্তু ফ্যাসিবাদ এবং শোষণ বিরোধী গান হিসেবে দেশ ও ভাষার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে এটি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে সারা বিশ্বে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় গানটি অনুদিত হয়েছে, বিভিন্ন দেশের শিল্পীরা একে নিজেদের মতো করে গেয়েছেন এবং বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় গানটি বারবার নতুন করে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
ইতালিয়ান ভাষায় ‘বেলা’ শব্দের অর্থ সুন্দরী, আর ‘চাও’ শব্দের অর্থ বিদায়। সুতরাং ‘বেলা চাও’ শব্দের অর্থ বিদায় সুন্দরী। বেলা এখানে পার্টিজান আন্দোলনের যোদ্ধাদের মাতৃভূমি, ইতালির প্রকৃতি। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত পার্টিজান আন্দোলনের এক কর্মীর মৃত্যুর শেষমুহূর্তের আকুতি এটা, যেখানে শত্রুবেষ্টিত অবস্থায় সে তার বন্ধুদের কাছে অনুরোধ করছে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, অথবা সে যদি মারা যায়, তাহলে তাকে পাহাড়ের উপর কবর দিয়ে একটি ফুল দিয়ে ছেয়ে দেওয়ার জন্য। গানটির হৃদয়স্পর্শী লিরিকের জন্যই এটি দেশ এবং কালের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের সকল দেশের আন্দোলন কর্মীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছে।
পার্টিজান আন্দোলনের সময় জনপ্রিয়তা পেলেও বেলা চাও গানটি ইতিহাস কিন্তু আরও পুরানো। এবং অধিকাংশ ফোক গানের মতোই এই গানটিরও প্রকৃত গীতিকার ও সুরকারের সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয়, গানটি প্রথম ইতালিতে জনপ্রিয়তা লাভ করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। সে সময় ইতালিতে, বিশেষ করে ইতালির উত্তরের পো উপত্যকার ‘মোন্দিনা’ নারীরা প্রতিবাদের অংশ হিসেবে এই গানটি গাইতেন।
মোন্দিনা বলতে ইতালির নারী চাষীদেরকে বোঝানো হয়, যারা মৌসুমের সময় ধানক্ষেতে কাজ করতেন। কঠোর পরিশ্রম, দীর্ঘ কর্মঘন্টা এবং কম মজুরির প্রতিবাদ হিসেবে তারা দল বেঁধে এই গান গাইতেন। তবে গানটির সুর একই থাকলেও কথাগুলো সে সময় একটু ভিন্ন ছিল। পার্টিজান আন্দোলনের পরিবর্তে সেখানে ছিল পোকামাকড় এবং মশার কামড়ের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন ভোরে উঠে কাজ করতে যাওয়ার কথা, পেছনে লাঠি হাতে জমির মালিকের দাঁড়িয়ে থাকার কথা, পরিশ্রম করতে করতে যৌবন হারিয়ে বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার কথা এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখার কথা।
তবে উৎস যাই হোক না কেন, বেলা চাও গানটি বিশ্ব জুড়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী গান হিসেবেই বেশি পরিচিত। বিশ্বের অন্য অনেক দেশের আন্দোলনের পাশাপাশি স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময়ও গানটির অনুবাদ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। নতুন প্রজন্মের অনেকেরই হয়তো গানটি সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু স্প্যানিশ টিভি সিরিয়াল ‘লা কাসা দে পাপেল’ এর দৌলতে আবার এ গান মানুষের মধ্যে এসেছে। তাই ‘বেলা চাও’ শুধু গান নয়, একটা সময়ের গল্প, একটা একটা আকুতির গল্প, ভালবাসার গল্প, সংগ্রামের গল্প বলে যাওয়ার একটা স্রোত বা সুর।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত