নানা পাটেকর অভিনীত ‘আব তক ছাপান্ন’ মনে আছে নিশ্চয়। অন্ধকার জগতের ত্রাস ‘এনকাউন্টার স্পেশালিষ্ট’ দয়া নায়েকের জীবনী নিয়ে তৈরি সিনেমা। নিজের এবং পরিবারের জীবনের ঝুঁকি থাকা স্বত্বেও তিনি মাথা নোয়াননি অপরাধীদের কাছে –এমনটাই দাবি করে থাকেন তাঁর ওপরওয়ালারা। কিন্তু দিনের শেষে তাঁর ডাকাবুকো শৌর্য ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ। এই দয়া নায়েকের মতো ‘ট্রিগার হ্যাপি’ পুলিশের সংখ্যা কম নেই যোগী রাজ্যে। অভিযোগ, হিন্দুত্বের ‘পোস্টার বয়’ তথা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের প্রশ্রয়ে তারাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। আসলে এনকাউন্টার। পোশাকি নাম ‘অপারেশন ক্লিন’। তবে ক্ষেত্র বিশেষে স্রেফ পদোন্নতি পেতে অপরাধ দমনের নামে অবাধে খুন করছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। আর একেই দেশের সামনে হাজির করা হচ্ছে ‘উত্তরপ্রদেশ মডেল’ বলে।
এমনিতেই উত্তরপ্রদেশ পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ কম নেই! মুখ্যমন্ত্রী হয়েই অপরাধ দমনে পুলিশকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন যোগী আদিত্যনাথ। আর তারপরেই ‘রোমিও স্কোয়াড’, ‘এনকাউন্টার’, ‘লাভ জিহাদ’-এর মতো একাধিক তত্ত্ব খাড়া করে গুলি চালানোর অভিযোগ লেগেছে পুলিশের উর্দিতে। মোটা টাকার বিনিময়ে কারও থেকে ‘সুপারি’ নিয়ে তার বিরোধীকে কোনও না কোনও মামলায় জড়িয়ে ‘এনকাউন্টার’ করে খতম করে দেওয়ার দুর্নামও আছে যোগীর পুলিশের বিরুদ্ধে। যে পুলিশের খাতায় যত বেশি ‘এনকাউন্টার’ তার তত বেশী খ্যাতি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আদিত্যনাথের প্রশ্রয়। সবমিলিয়ে ভয়ঙ্কর এবং বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যোগীর পুলিশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী যোগীর উত্তরপ্রদেশে ১,১০০ এনকাউন্টার করেছে পুলিশ। তাতে ৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৩৭০ জন।
উত্তরপ্রদেশ সরকারের ‘পুলিশি অভিযান’–এর নানা তথ্য-সহ সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ’ (পিইউসিএল)। এনকাউন্টারের অছিলায় মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতায় ‘খোলাখুলি অগ্রাহ্যে’ রাজ্য সরকারের অনুমোদন আছে বলে আবেদনে জানিয়েছিল তারা। তাদের অভিযোগ ছিল, অভিযুক্তদের বিচার প্রক্রিয়ায় না এনে, তাদের শেষ করে দেওয়ার নিদান দিয়েছে যোগী সরকার। তাই দাবি জানান হয়েছিল সিবিআই তদন্তের। চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি এর শুনানিতে বিষয়টিকে ‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ’ আখ্যা দিয়েছিল প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ। যোগী সরকারের লিখিত জবাবদিহি চেয়েছিল। তা সত্ত্বেও আজও সমানে সেই প্রবণতা চলছে।
যোগী বলেছিলেন, ‘অপরাধীদের হয় কারাবাস হবে নয়তো তাদের এনকাউন্টারে খতম করা হবে। সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়াই আমাদের কাজ। তবে যারা সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, হাতে বন্দুক তুলে নেয়, তারা সেই ভাষাতেই জবাব পাবে।’ এই মন্তব্যের সূত্র ধরে রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়েছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। জানিয়েছিল, ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করা অপরাধ দমন করার সঠিক পথ নয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে দেওয়া লিখিত জবাবে উত্তরপ্রদেশ সরকার জানায়, ২০১৭-র ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৮-র মার্চ অবধি এনকাউন্টারে ৪৫ জন প্রাণ হারিয়েছে। জানা গেছে, যোগী সরকারের প্রথম ১০ মাসেই শুট আউটে ৩৪টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ২৬৫ জন জখম হয়েছে। অভিযোগ, এরা সবাই অপরাধী নয়। এবং এনকাউন্টারে মৃত্যুর ঘটনায় মামলা নথিভুক্ত করা বা তদন্ত করার আইনি প্রক্রিয়াও মানা হয়নি। এটাই হল ‘উত্তরপ্রদেশ মডেল’-এর আসল রূপ। যেখানে বন্দুকবাজ পুলিশ গুলি চালানোর আগে কে দোষী আর কেই বা নিরপরাধ, সেই বাছবিচার করে না।