গত এক মাস বা বলা ভালো তারও বেশি সময় ধরে ভাটপাড়ায় যে অশান্তির আগুন জ্বলছে, তারজন্য দায়ী কোনপক্ষ? বৃহস্পতিবারে পরপর দুটো খুন এবং বোমা বিস্ফোরণের পর থেকে সেই উত্তরই খোঁজার চেষ্টা করছেন কাঁকিনাড়া, জগদ্দল, ভাটপাড়ার বাসিন্দারা।
বৃহস্পতিবার যে কাছারিপাড়া রোডে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় রামলাল সাউ এবং ধর্মবীর সাউয়ের, তার ঠিক উল্টোদিকেই কাছারিপাড়া বাজার। আগের ভাটপাড়া ফাঁড়ি, বর্তমানে থানা থেকে মাত্র একশ মিটারের মধ্যে এই বাজার এলাকার বড় ‘বাজার’ হিসাবে পরিচিত। জামাকাপড়ের দোকান থেকে শুরু করে সোনার দোকান বা বৈদ্যুতিন সামগ্রী সমস্ত কিছুর দোকান মিলিয়ে কয়েকশোর ওপর দোকানঘর আছে এই বাজার এলাকার মধ্যে।
এই বাজারেই দোকান আছে রাজীব চৌধুরীর। শুক্রবার দুপুরে বাজারের বিভিন্ন অংশে ভাঙচুর হওয়া দোকানঘর দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘‘গত একমাসে হাতে গোনা কয়েকটা দিন দোকান খুলতে পেরেছি। তাতেও বিশেষ লাভের মুখ দেখতে পারিনি। এই অশান্তির পরিবেশে খরিদ্দার নেই।’’ একই অভিজ্ঞতা তাঁর মতো সেই বাজারেরই আরও বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর। তাঁদেরই একজন বলছিলেন, প্রতি বছর ঈদের আগে তাঁদের ভাল ব্যবসা হয়। এবার তা একদমই হয়নি। শুনসান বাজারে রাতের অন্ধকারে সিঁদ কাটে চোরেরা। শুধু দিনের বেলায় টহল দেয় পুলিশ।
এলাকার বাসিন্দা রাজেশ চৌধুরী বলেন, “১৯ মে ভাটপাড়া বিধানসভার নির্বাচনের দিন থেকে যে অশান্তি শুরু হয়েছে, তা চলছে এখনও। ওই দিন থেকে শুক্রবার পর্যন্ত একটা দিনও যায়নি, যে দিন এলাকায় প্রকাশ্যে বোমাবাজি হয়নি। গত এক মাসের হিংসায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫ জন। কিন্তু হিংসা থামার কোনও লক্ষণ নেই।”
ব্যারাকপুর স্টেশনের পাশ থেকে শুরু হওয়া ঘোষপাড়া রোড পলতা, ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরির পাশ দিয়ে গিয়ে শ্যামনগর জগদ্দল হয়ে পৌঁছেছে কাঁকিনাড়া। ডানদিকে ঘুরে সেই রাস্তাই ভাটপাড়া থানার পাশ দিয়ে রেল ব্রি়জ টপকে চলে গিয়েছে প্রাচীন ভট্টপল্লী বা ভাটপাড়ার দিকে। হুগলি নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা চটকলের কাজ নিয়ে এখানে বসবাস শুরু করেন বিহার উত্তর প্রদেশের দুই সম্প্রদায়ের হিন্দিভাষী মানুষ। এলাকার বাসিন্দারা স্বীকার করেন, কারণে অকারণে অশান্তি এর আগেও হয়েছে। কিন্তু কোনও অশান্তিই এতদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
সেখানকারই এক বাসিন্দা দিলীপ সাউয়ের দাবি, ২৩ মে নির্বাচনের ফল ঘোষণার কয়েকদিন পর থেকে পাল্টা প্রতিরোধে নামে বিজেপি কর্মী সমর্থকরা। নির্বাচনের ফলাফল থেকে ততক্ষণে পরিষ্কার অর্জুন সিংহের হাত ধরে গোটা এলাকার রাজনৈতিক ক্ষমতার দখল নিয়েছে বিজেপি।
ভাটপাড়ায় ১০০ বছরেরও বেশি বংশপরম্পরায় থাকা এক প্রবীণ বাসিন্দা রমাকান্ত বলেন, ‘‘এই ঘটনার পর থেকেই বিজেপি এখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষ ছড়িয়ে দেয়।” কিন্তু অভিযোগ, তার পরেও তৎপর হয়নি পুলিশ। নাম কা ওয়াস্তে কিছু ধরপাকড় হলেও, ঈদের ঠিক আগেই জেল থেকে আকস্মিক ভাবে ছাড়া পেয়ে এলাকায় ঢোকে কুখ্যাত দুষ্কৃতীদের দল। একই ভাবে যারা একসময় পুলিশের ভয়ে এলাকা ছাড়া হয়ে গিয়েছিল, সে রকম আরও কিছু কুখ্যাত ক্রিমিনালকে এ বার দেখা যায় পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে ঘুরে বেড়াতে। প্রকাশ্যে শুরু হয় লুঠপাট।
এলাকার মানুষকন যাঁদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ করছেন, সেই পুলিশ কর্তাদের একাংশের বক্তব্য খুব পরিষ্কার। দীর্ঘদিন এই এলাকায় কাজ করা এক পুলিশ কর্তা বলেন, ‘‘দেখুন, এই অশান্তি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া মিটবে না। পুলিশের কিছু দোষ আছে সেটা ঠিক, কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা নিজেরা সংযত না হলে এই লড়াই থামবে না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এ ধরনের সংঘর্ষ দ্রুত ছড়ায়। কিন্তু এখানে আশপাশের কোনও এলাকায় এই অশান্তি ছড়ায়নি। যা হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট জায়গাতেই। এর থেকেই স্পষ্ট, এই হিংসা খুব পরিকল্পিত, যেখানে রয়েছে রাজনৈতিক মস্তিস্ক।
তাঁর মতোই অন্য এক আধিকারিক বলেন, ‘‘ভোটের পর চার জন কমিশনার এলেন এখানে এক মাসে।” তাঁর কথায়, “সদ্য ক্ষমতা অর্জন করা এক ব্যক্তি নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা আরও বাড়াতে চাইছেন। তাই জোর করে হিংসে ছড়াচ্ছেন। এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে।”