‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন’। এবার ডাক্তারদের ভাবনাহীন চিত্তের জন্যেই প্রাণ গেল এক দুধের শিশুর! হ্যাঁ,
চিকিৎসকদের কর্মবিরতির মধ্যেই জন্ম। আবার কর্মবিরতির মধ্যেই মৃত্যু ঘটল এক সদ্যোজাতর। আর ওই তিন দিনের শিশুটির পরিজনেরা শুধু এটুকু জানেন, রাজ্য জুড়ে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি চলার মধ্যেই জন্ম নেওয়া তাঁদের ফুটফুটে ছেলেটা স্রেফ ভেন্টিলেটরের সুবিধা না পাওয়ায় দিন দুয়েকের বেশি পৃথিবীর আলো দেখতে পারল না।
বৃহস্পতিবার সকালে এমনই ঘটনা ঘটেছে কামারহাটির সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। গত ১০ জুন মধ্যমগ্রামের গঙ্গানগর কাঁটাখালের বাসিন্দা ঝুম্পা কর্মকার মল্লিক ওই হাসপাতালে ভর্তি হন। পরের দিন তাঁর পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। এ দিন সকালে মৃত্যু হয় সেই শিশুর। ঝুম্পার স্বামী অভিজিৎ মল্লিক জানান, জন্মের পরে সুস্থ ছিল শিশুটি। পরে শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় সাগর দত্ত হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, তাকে ভেন্টিলেশনে দিতে হবে। কিন্তু কামারহাটির ওই হাসপাতালের এসএনসিইউএ সেই সুবিধা না-থাকায় অভিজিৎকে অন্যত্র যোগাযোগ করতে বলা হয়। যদিও তত ক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি।
বৃহস্পতিবার, সাদা কাপড়ে মোড়া সন্তানকে কোলে আঁকড়ে হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় কান্নায় ভেঙে পড়া অভিজিৎ বলেন, ‘কর্মবিরতির জন্য আমার বাচ্চাটা মরে গেল। এতগুলো হাসপাতালে গেলাম, কোথাও কিছু হল না। ওর কী দোষ, বলতে পারেন।’ অভিজিতের দাবি, তিনি ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ, নীলরতন সরকার, আরজিকর হাসপাতালে গেলেও চিকিৎসকদের কর্মবিরতি চলছে বলে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তবে বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতাল এবং ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এ অভিজিতকে ঢুকতে দেওয়া হলেও ভেন্টিলেটর পাওয়া যায়নি।
কর্মবিরতির সময়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এনআরএসেও। বুধবার রাতে এনআরএস-র নিউরোলজি বিভাগে ভর্তি থাকা ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছিল বাবার। বৃহস্পতিবার সকালে হাসপাতাল থেকে ফোন পেয়ে সোদপুরের বিশ্বনাথ দাস তড়িঘড়ি গিয়ে দেখলেন, ছেলে কৌশিকের মৃত্যু হয়েছে। দিন সাতেক আগে বাইক দুর্ঘটনায় পায়ে চোট পেয়েছিলেন ওই যুবক। প্রথমে আরজি কর হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা হয়। পরে আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলেও খরচ জোগাতে না পেরে ছেলেকে এনআরএস হাসপাতালে ফের ভর্তি করান বিশ্বনাথবাবু। সোমবার হাসপাতালে কর্মবিরতি শুরুর আগে ওই যুবকের পায়ে অস্ত্রোপচার হয়। বিশ্বনাথবাবুর অভিযোগ, ‘কর্মবিরতির জেরে চিকিৎসা না পেয়ে ছেলেটা মারা গেল।’
ওই হাসপাতালেই চিকিৎসার অভাবে মা মঞ্জুদেবীর মৃত্যুর অভিযোগ তুলেছেন সোনারপুরের বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্জুদেবী মেডিসিন বিভাগে ভর্তি ছিলেন। বিজয় বলেন, ‘কর্মবিরতি শুরু হওয়ার পরে মা আর ঠিক মতো অক্সিজেন ও ওষুধ পাচ্ছিলেন না দেখে নার্সদের বলেছিলাম। কিন্তু তাঁরা জানিয়ে দেন, চিকিৎসকদের নির্দেশ না পেলে কিছু করতে পারবেন না।’ একই অভিযোগ জেলাতেও। মাথায় গুরুতর চোট পাওয়া বয়স ১৭-র শেখ শামিমকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলেও আধ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়। মেদিনীপুর শহরের পাথরঘাটার বাসিন্দা ওই কিশোরের পরিজনদের অভিযোগ, দেরিতে চিকিৎসা শুরু হওয়ার কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এভাবেই ডাক্তাতদের ‘কর্মবিরতিতে’ মৃত্যু মিছিল চলছে রাজ্য জুড়ে।