আমাদের স্বাধীন দেশে প্রতিটি মানুষের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা আছে। বিখ্যাত কবি ও গীতিকার কায়ফি আজমি সবরকম ধর্মীয় বাতাবরণ সরিয়ে রামকে সহজভাবে বলতে পেরেছিলেন ইমাম উল হিন্দ, মানে ভারতের সবচেয়ে সন্মানিত মানুষ। এই তো আমাদের দেশ! কিন্তু জয় শ্রীরাম কথাটাকে ইদানিং একদল লোক এমন উস্কানিমূলকভাবে ব্যবহার করছেন তাতে আমার অত্যন্ত আপত্তি আছে।
প্রবল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে দেশে বিজেপি ফিরে আসা ও রাজ্যে অপ্রত্যাশিত ফল করার পর একশ্রেণীর সমাজবিরোধী এটাকে করে ফেলেছেন এক আস্ফালনের ধ্বনি। অস্থানে, কুস্থানে জয় শ্রীরাম বলে পিলে চমকানো চিৎকার করে চলেছে তারা। আমার মনে পড়ছে, আদবানীর রথযাত্রার সময়ও জয় শ্রীরাম ধ্বনিটা করসেবকদের মুখে মুখে ফিরতো, তৈরি করতো একটা আতঙ্কের পরিবেশ। ধর্মান্ধ রাজনীতিবিদদের হাতে জয় শ্রীরাম হয়ে উঠেছে দাঙ্গার ধ্বনি, সেখানে রামের প্রতি কোন ভক্তি নেই। ঘৃণার রাজনীতি এই ধ্বনির জমি তৈরি করেছে। রামের প্রতি ভক্তি জানানোর আওয়াজকে বিভেদপন্থী রাজনীতি করে তুলেছে প্ররোচনার হাতিয়ার।
গতকাল নৈহাটিতে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান বিক্ষোভের সময় আমি লক্ষ্য করছিলাম কীভাবে কিছু দুর্বৃত্ত অকারণে জয় শ্রীরাম বলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে চাইছে। মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ের নিরাপত্তা না মেনে তারা লাগাতার জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিতে দিতে তার কনভয়ের কাছে চলে আসছিল। উদ্দেশ্য ছিল যদি নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিত তবে সেটাকে কেন্দ্র করে একটা হাঙ্গামা বাঁধানো। রাম নামের কী অপব্যবহার! বিভেদপন্থার রাজনীতি একদল তৃতীয়শ্রেণীর লুম্পেনের মুখে রাম নাম তুলে দিল।
সাংবাদিকতার সূত্রে বেশ কয়েকবার দাঙ্গা কবলিত এলাকার ঘোরার দুর্ভাগ্য হয়েছে আমার। আমি দেখেছি, ধর্মীয় উন্মাদনা কীভাবে শান্ত মানুষকেও নিমেষে ঘাতক করে তোলে। আমি দেখেছি, দীর্ঘদিন ধরে এক পাড়ায় গলাগলি করে বাস করা মানুষ দাঙ্গার দিনে কীভাবে পরস্পরের শত্রু হয়ে ওঠে। শুনশান রাস্তা, সেনাবাহিনীর বুটের শব্দ, আগুন লাগা ঘরবাড়ি, মানুষের আর্ত চিৎকার, দরজা জানলার ফাঁক থেকে উঁকি মারা চোখ, শিরদাঁড়ায় বইয়ে দিচ্ছে ঠাণ্ডা স্রোত, আর মাঝেমধ্যে আওয়াজ ভেসে আসছে জয় শ্রীরাম। আবার তার পরপরই শুনছি আল্লা হো আকবর। ঈশ্বরের নামে তখন আর আশ্বস্ত হওয়া যায়না শুধু আতঙ্ক হয়। আজ যারা জয় শ্রীরাম বলে হাঙ্গামার উস্কানি দিচ্ছে এমন পরিস্থিতি হলে তখন তারা নিজেরাও বিপদে পড়ে যাবে।
অনেকে বলবেন, জয় শ্রীরামে আপত্তি কীসের? এতো রামের জয়গান করা। তাদের বলি, স্থান, কাল পাত্র বদলে গেলে কোন জয়ধ্বনি নির্দোষ থাকে না। তা হয়ে ওঠে বিভেদের স্তূপে আগুন ধরানোর বারুদ। কোন হিন্দুর পূজাপাঠের সময় যদি কেউ পাশে অকারণে আল্লা হো আকবর বলতে থাকেন তাহলে সেটা কখনোই একটা নির্দোষ ধ্বনি থাকেনা, হয়ে ওঠে একটা প্ররোচনা। আবার নামাজের সময় পাশে একটা মাইক বাজিয়ে দিলে লাগাতার জয় শ্রীরাম বলতে থাকলে সেটা হাঙ্গামা বাঁধানোর চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। রাজ্যে জয় শ্রীরাম ধ্বনি স্পষ্টতই একটা প্ররোচনা। বাংলার রাজনীতিতে এটা বিজেপির এক নবতম উপহার। তারাই এই প্ররোচনার রাজনীতি শুরু করেছে। এতে তাদেরই হাত পুড়বে সবথেকে বেশি।�
একে প্রতিরোধ করতে হবে। নাহলে রাজ্য এক ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের দিকে যাবে। দুঃখের কথা সেটা হচ্ছে না। বহু জায়গায় রাজ্যের শাসকদলের স্থানীয় কর্মীদের পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর অত্যাধিক নির্ভরতা কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলার মানসিকতাই নষ্ট করে দিয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসন নয়, রাজনীতিটা যে মানুষকে নিয়ে করতে হয় একথাটাই শাসকদলের একশ্রেণীর নেতা ভুলে গেছেন। কাল নৈহাটিতে দিদির অবস্থান বিক্ষোভের সময় দেখলাম কিছু নেতা, এদের মধ্যে নৈহাটি পুরসভার চেয়ারম্যানও ছিলেন তারা মঞ্চে উঠে তৃণমূল নেত্রীর সামনে একি হল ঢঙে হাউহাউ করে কাঁদছেন। ভাবটা এমন, যেন বলছেন, ওরা আমায় মেরেছে ওদের তুমি একটু বকে দাও। বিভেদপন্থীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় ভিত্তিতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার বদলে এই কান্নাকাটির অসহ্য নাটক এবার বন্ধ হোক। জনসভায় কান্নাকাটি করলে কর্মীদের যে হতাশা তৈরি হয় এই কাণ্ডজ্ঞানটুকুও এদের নেই।
কর্মী, সমর্থকদের ওপর বিজেপির আক্রমণ দিনদিন আরও তীব্র হচ্ছে। এটা শুধু বিবৃতি বা বিক্ষোভ দেখিয়ে বন্ধ হবে না। এটা রুখতে দল বেঁধে পথে নামতে হবে। দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি সেটা হচ্ছে না। দল সঙ্গে থাকবে, নেতৃত্ব দেবে, পুলিশ আইনভঙ্গকারীদের শাস্তি দেবে, কর্মীদের সুরক্ষাও দেবে কিন্তু রাস্তায় নেমে প্রতিরোধটা করতে হবে আপনাদেরই।
বলতে খারাপ লাগছে ক্ষমতার স্বাদ, সুবিধাবাদী মনোভাব, দুর্নীতি দলের বেশকিছু মানুষের শিরদাঁড়াটা বেঁকিয়ে দিয়েছে। রাজনীতিটা যে মানুষকে নিয়ে করতে হয়, দল যে মানুষকে নিয়ে চলে একথাটাই ভুলে গেছেন একশ্রেণীর নেতা ও কর্মী। অথচ চোখের সামনে আমি দেখছি ভোটের আগে অবিশ্বাস্য পরিশ্রমের পরও কিন্তু বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কোন বিশ্রাম নেই, তিনি লাগাতার কাজ করে চলেছেন, সাহস দিচ্ছেন কর্মীদের, রুখে দাঁড়াচ্ছেন হাঙ্গামাবাজদের বিরুদ্ধে। ষাটোর্ধ নেত্রী যদি এতটা সক্রিয় হতে পারেন তাহলে তরুণ নেতা ও কর্মীদের সক্রিয় হতে অসুবিধা কোথায়? কেন এরা শুধুই দল, নেত্রী, পুলিশ, প্রশাসনের করুণাপ্রার্থী? এই প্রশাসন ও পুলিশ নির্ভরতাই কিন্তু সিপিএমের মত ৩৪ বছর রাজত্ব করা একটা রেজিমেন্টেড পার্টিকে প্যাভেলিয়নে পাঠিয়ে দিয়েছে।
ভয় কীসের? জয় শ্রীরামে চমকাবেন না। মনে রাখবেন হাঙ্গামাবাজ বিভেদপন্থীরা সবসময় সংখ্যায় কম। তারা মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া বাঁধায়। মানুষের পাশে থাকলেই এই দুর্বৃত্তগুলোকে চিনতে পারবেন, তাদের প্রতিরোধ করার কাজও সহজ হবে। বন্ধু, সতীর্থরা আক্রান্ত হলে নিশ্চয়ই খারাপ লাগবে কিন্তু আরও খারাপ লাগবে এই দেশটাতে যদি কোন মানুষ না থেকে শুধু ধর্ম থাকে।
অনেকে বলছেন, জয় শ্রীরাম ধ্বনি শুনে মুখ্যমন্ত্রী রেগে যাচ্ছেন কেন? কারণ, আমাদের দেশে এই ধ্বনির সঙ্গে জড়িয়ে আছে দাঙ্গা-হাঙ্গামার ইতিহাস। বাংলায় শান্তি বজায় রাখার জন্য যে কোনরকম দাঙ্গা বাঁধানোর আওয়াজকে রুখতে হবে। বলতে হবে মানব ধর্মের কথা।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত