আগের লেখাটাতে আমি লিখেছিলাম আমাদের আত্মসমালোচনা করতে হবে, করতে হবে আত্মানুসন্ধান। এটা ঘটনা আমাদের ব্যর্থতা ও ভ্রান্তির সুযোগ নিয়েছে বিজেপি। রাজ্যে বিজেপির সমর্থক কেন বাড়ছে তার উত্তর খোঁজা থেকেই এই ভুলের কারণ অনুসন্ধান করতে শুরু করতে পারি আমরা। ধূর্ততা, কূটবুদ্ধির বিচারে মোদি সাম্প্রতিক অতীতে সব বিজেপি নেতাদের ছাপিয়ে গেছেন। হিন্দু ভোটকে তিনি যতটা সংহত করতে পেরেছেন এর আগে কোন বিজেপি নেতাই তা পারেননি। আমি বাজপেয়ী, আদবানিদের ধরেই একথা বলছি। লক্ষ্যে পৌঁছতে তিনি নিয়েছেন দ্বিমুখী নীতি। একদিকে বলছেন সব কা সাথ সব কা বিকাশ, অন্যদিকে পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ছড়াচ্ছেন বিদ্বেষ। দেশবাসীদের বোঝাচ্ছেন, মুসলমানদের জন্যই হিন্দুরা এগোতে পারছে না। এখানেই তিনি থামেননি, তিন তালাক নিষিদ্ধ করাকে সমর্থন করে মুসলিম সমাজের শিক্ষিত ও আলোকপ্রাপ্ত শ্রেণির একটা অংশকে তিনি কাছে টেনেছেন। বিরোধী শিবির এই চতুর আক্রমণের সঠিক মোকাবিলা করতে পারেনি। বরং তাদের অবস্থানে মুসলমানরা বিভ্রান্ত হয়েছেন। বিরোধীরা এমন একটা অবস্থান নিলেন যাতে মনে হল তিন তালাক প্রথাকে তারা বজায় রাখতে চান।
মোদিকে চেনা যায় যখন তিনি আগ্রাসী হিন্দুত্বের কথা বলেন। কিন্তু যখন তিনি বাজার অর্থনীতির ওপর নির্ভরতা কমানোর কথা বলেন, লালফিতের ফাঁস থেকে দেশকে মুক্ত করার কথা বলেন, বেকারদের অভয়বাণী দিয়ে বলেন চাকরির সুযোগ তৈরি করার কথা তখন খুব সচেতন মানুষও ধন্ধে পড়ে যান, তারা বিভ্রান্ত হন। ভাবেন, একে আরেকবার সুযোগ দিয়ে দেখা যাক। ব্যাপারটা কেমন তা একটু পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা যাক। নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম ভাষণেই সব কা সাথ সব কা বিকাশের সঙ্গে মোদি সুচতুরভাবে জুড়ে দিলেন সব কা বিশ্বাস কথাটা। অর্থাৎ সবার বিশ্বাস অর্জন করে এবং সবার উন্নয়নের কথা ভেবেই তিনি সরকার চালাবেন। আমার অনেক বন্ধুবান্ধবই তো বললো, এত মেজরিটি পেয়ে আসার পরও সবাইকে নিয়ে চলতে চাইছেন। এটা একটা দারুণ ব্যাপার। মোদি কিন্তু চেঞ্জ করে গেছেন। আমার মতে, ব্যাপারটা কিন্তু এত সোজা নয়। এর পিছনে আছে সুচতুর রাজনীতির খেলা। আপনাদের আমি মনে করিয়ে দেবো এবারের ভোটের রেজাল্ট বেরোবার পরেই আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের একটা ঘোষণা, তা হল রামমন্দির হবেই।
মানুষের কাছে এই দ্বিচারণার মুখোশ খুলে দেওয়ার কাজ করার জন্য আমাদের সবাইকে রাজনৈতিকভাবে তৈরি হতে হবে। অত্যন্ত ভক্তি ও বিশ্বাস সহকারে দিন রাত জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ বলে গেলে কিংবা কোন সুযোগসুবিধা বাগানোর জন্য স্থানীয় দাদাদের সঙ্গে ঘুরলে কিংবা টু পাইস কামানোর ধান্ধায় ব্যস্ত থাকলে একাজ হবে না। সত্যি বলতে কী, ধান্দাবাজ রাজনৈতিক কর্মীদের দলের দরকার নেই। বরং দলে টেনে আনতে হবে রাজনীতি সচেতন স্থানীয় ছাত্রযুবদের।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে তৃণমূলের আশেপাশে আমি এমন সব যুবছাত্রদেরই দেখেছি। জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে লড়াই করেছেন অনেক উজ্জ্বল ছেলেমেয়েরা। পরবর্তীকালে এরা কেমন যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এদের কোন প্রাপ্তিযোগের ভাবনা ছিল না। সিপিএমের বিরুদ্ধে অকুতোভয় জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই এদেরকে আন্দোলনের ময়দানে টেনে এনেছিল। পরবর্তীকালে ধান্দাবাজ বেনোজলের দাপটে এরা দূরে সরে গেছেন। বাংলার রাজনীতিতে এটা একটা বড় ক্ষতি।
আবার যারা ডান থেকে অতিবাম বিভিন্ন ধারার রাজনৈতিক দল থেকে আসা নেতা, কর্মী ও সমর্থকরা এই লড়াইয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তারাও পরবর্তীকালে কেমন যেন মিইয়ে গেলেন। যারা থাকলেন তারা শুধু পদ, গোষ্ঠী, রাজনীতি, ঠিকাদারি ইত্যাদি নিয়েই ব্যস্ত থাকলেন। সংগঠনকে বিস্তৃত করতে কোন ভূমিকাই নিলেন না। আত্মসমালোচনার দরকার এদেরও। তৃণমূল নেত্রীর পাশে গোটা দল তো অবশ্যই থাকবে, সঙ্গে থাকতে হবে এই রেনবো কোয়ালিশনকেও।
সাম্প্রতিক একটা লেখায় নোবেলজয়ী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন ভারতের এই ভোট একটা আতঙ্ক সৃষ্টিকারী বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছুই নয়। বিজেপির গত পাঁচ বছরের শাসনে দেশের ধর্মীয় বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়েছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এই লড়াইয়ে জিতলেও আদর্শের দিক থেকে তেমন নতুন কিছু দিতে পারেনি। অত্যন্ত সঠিক কথা। ভোটে জিতে আসা বিজেপি সদস্যা প্রজ্ঞা ঠাকুর বললেন, নাথুরাম গডসে একজন দেশপ্রেমিক, যা বিজেপি নেতাদেরও অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। এমন মানসিকতার প্রার্থীদের জয়কে কোন কান্ডজ্ঞান্সম্পন্ন মানুষ গণতন্ত্রের জয় বলতে পারেন?
বিরোধী দলগুলির অনৈক্য, কাণ্ডজ্ঞানহীন রাজনীতি, আসল বা বড় বিপদটাকে বোঝার অক্ষমতার যোগফলেই বিজেপি আবার ক্ষমতায় ফিরে এল আরও বেশি শক্তি নিয়ে। তাই বলছি, আদর্শবোধ না থাকলে এই রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে না। মনে রাখতে হবে বিভেদপন্থার জয় সাময়িক হতে বাধ্য। মুষড়ে পড়ার কোন কারণ নেই। মানুষ, সংগঠন, রাজনীতি, সরকার ভালো খারাপ যাইহোক না কেন তার কৃতকর্মের ফল পায়। গত আট বছরে রাজ্যে কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, রুপশ্রী, শিক্ষাশ্রী, সবুজশ্রী, খেলাশ্রী সহ মোট কুড়িটি যোজনা রূপায়িত হয়েছে। উপকৃত হয়েছেন মানুষ, এগিয়েছে রাজ্য। এই কাজ ব্যর্থ হতে পারেনা। নানা রাজনৈতিক ভ্রান্তির ফলেই দল এই সুফল ঘরে তুলতে পারেনি। এই ভ্রান্তি কাটলেই ছবিটা আবার বদলে যাবে।