মানুষের মমতা
আমার দিন, তারিখ, বার সব কেমন যেন গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। প্রচার শেষ হওয়ার পরদিন ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। বেরনোর প্রস্তুতি শুরু করেছি, হঠাৎ মনে হল আরে আজকে তো আর বেরনো নেই, গতকাল রাতে তো প্রচার শেষ হয়ে গেছে। গত ৩রা এপ্রিল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী সফর কভার করার জন্য। অন্ধ্র, আসাম হয়ে বাংলার উত্তরপ্রান্ত থেকে দক্ষিণপ্রান্ত সব জেলা ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলি ঘুরতে ঘুরতে কত মাইল হেঁটেছি, কতটা ঘুরেছি তার সবকিছুই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে।

আমার মনে শুধু জেগে রয়েছে প্রখর রোদ, মাইলের পর মাইল হাঁটা, অসংখ্য মানুষ, সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলা এবং ঘন্টার পর ঘন্টা বক্তৃতা দেওয়ার পরও সমান উৎসাহে পরের দিনের সফরের জন্য তৈরি হওয়া জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। আরেকটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি, এসবের সঙ্গে তাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কিছু অবশ্য পালনীয় কাজ, যেমন ফণী মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এবং জরুরি� সাংগঠনিক দায়িত্ব ইত্যাদিও পালন করতে হয়েছে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বাস কতটা বেশি থাকলে, আদর্শের প্রতি কতটা নিষ্ঠা থাকলে চুপচাপ নীরবে একাজ করা যায় আমি এই দীর্ঘ সফরে তা চোখের সামনে দেখেছি।
দেশের অন্যান্য বড় রাজনৈতিক দলগুলির তুলনায় তৃণমূলের আর্থিক ক্ষমতা কম, তাই আকাশপথের তুলনায় মূলত গাড়িতে এবং হেঁটে তিনি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছেন। গোটা সফরে আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি মানুষের কাছে পৌঁছলেই তিনি যেন উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। চার্জ করে নেন তার কর্মক্ষমতার ব্যাটারিকে। আর মানুষও রোদ, বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে শুধু তাকে দেখবে বলে, প্রণাম করবে বলে, একটু ছোঁবে বলে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেন। এই ব্যাপারটা আমি দেশের আর কোন রাজনৈতিক নেতার ক্ষেত্রে দেখিনি। আমার মনে হয়েছে দিদিকে তারা শুধু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বা রাজনৈতিক নেত্রী বলে মনে করেন না। তারা তাকে মনে করেন একজন অভিভাবক, যিনি তাদের শাসনের পাশাপাশি স্নেহ এবং নতুন পথের দিশা দেখান।
এই সফরে আমি বুঝতেই পারিনি যার সফর আমি কভার করছি তিনি নীরবে, নিঃশব্দে তৈরি করে ফেলেছেন রাজনৈতিক প্রচারের নতুন রেকর্ড যা স্বাধীনতার আগে ও পরে গোটা দেশে কোন রাজনৈতিক নেতা করেননি। বাংলার প্রতিটি জেলা ছাড়াও অসম ও বিশাখাপত্তনম মিলিয়ে গত ২রা এপ্রিল থেকে ১৬মে পর্যন্ত ১০৫টি সভা প্রতিদিন গড়ে ৩টি সভা, প্রতিটি সভায় গড়ে ১ঘন্টা বক্তৃতা; সভা শেষে ৫ থেকে ১৪ কিলোমিটার পদযাত্রা, এই ছিল তার দিনলিপি। এ এক অবিশ্বাস্য কাজ! আমরা সবাই তার বেশভূষা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। পিচগলা গরমে হাওয়াই চটি পরে এই কাণ্ড ঘটাতে পারার মত বুকের পাটা কারও আছে বলে আমার মনে হয় না। গত ৪৫দিন ধরে এই কাজটি সম্পন্ন করলেন একজন ষাটোর্ধ মহিলা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার হাওয়াই চটি নিয়ে যারা ট্রোল বা মেমে করেন তারা এটা জানার পর কী করবেন আমি জানিনা।
হিউয়েন সাং, মেগাস্থিনিস, ফা হিয়েন কিংবা অতীশ দীপঙ্করদের পদব্রজে ঘোরার কথা আমি ইতিহাসে পড়েছি। কিন্তু চোখের সামনে এরকম জিনিস প্রথম ঘটতে দেখলাম। প্রতিকূল আবহাওয়াতেও এই অসাধ্যসাধন যিনি করলেন তাকে আমি এক মুহূর্তের জন্য ক্লান্ত হতে দেখলাম না। ভাবছিলাম, এত শক্তি তার কোথা থেকে আসে? মোদি-অমিতদের মত তুচ্ছ রাজনৈতিক ধান্দাবাজ এই হিসেব মেলাতে পারবেন না। আবার চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও চমকে যাবেন তার শারীরিক সক্ষমতা দেখে। বিজ্ঞান বলে একজন কঠোর পরিশ্রমী শ্রমিক দিনে প্রায় ১৪০০ থেকে ১৮০০ ক্যালোরি এনার্জি খরচ করেন। একজন পুরুষ অ্যাথলেটের খরচ হয় ১০০০ থেকে ১২০০ ক্যালোরি। সেই হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর গত ৪৫ দিনের দাঁড়ানো, হাঁটা, বক্তৃতা, ঘাম ঝরানো সব মিলিয়ে প্রতিদিনের এনার্জি ক্ষরণ প্রায় ২৪০০ ক্যালোরি, যা একজন শ্রমিক বা অ্যাথলেটের থেকে অনেক বেশি এবং দেড়মাসের হিসেবে এক লক্ষ আট হাজার ক্যালোরি যা পৃথিবীর যে কোন কঠোর পরিশ্রমের প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার।
অবিশ্বাস্য লিখলাম একারণেই যারা মুখ্যমন্ত্রীর খাদ্যাভাস জানেন তাদের মতে তিনি যেটুকু খান তাতে আর যাইহোক এই পরিমাণ পরিশ্রম করা যায়না। তার বিশ্রাম বলতে শুধু ২ঘন্টা ঘুম। জানি এই তথ্য তার কাছে পৌঁছলে তিনিই সব থেকে বেশি অবাক হবেন। গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে নাম তোলার কোন আগ্রহ তার নেই বলেই আমি জানি। নিজের এই অমানবিক ক্ষমতার কথা তিনি নিজেই জানেন না। কাজের নেশায় মানুষকে ভালোবেসে তিনি কাজ করে যান। ধোনি যখন বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে ছক্কা হাঁকান তখন অতি বড় নাইট রাইডার্স ভক্তও হাততালি দেন। তখন আর চেন্নাই কলকাতা প্রতিযোগিতাটা থাকেনা। তাই অনুরোধ দলাদলি না করে অন্তত এই কাজটাকে অন্যভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দায়টা আমাদের সকলের। বিস্ময়কর রাজনৈতিক প্রচারের সুবাদেই গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে যাতে তার নাম উঠতে পারে তার জন্য আমাদের সবার সচেষ্ট হওয়া উচিৎ। আমার সৌভাগ্য যে এবারের নির্বাচনে তার প্রচার পর্বের প্রায় প্রতিটা দিনই আমার তার সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছে, কথাও হয়েছে একাধিকবার।
ব্যক্তি রাজনীতি করে আবার রাজনীতি ব্যক্তিকে তৈরি করে নেয়। এটা হয় আদর্শ, ব্যক্তিত্ব ও নিষ্ঠার জন্য। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এমন রাজনীতিবিদদের মানুষ দেখেছেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তেমনই একজন জননেত্রী, তাই তিনি এই অসাধ্য সাধন করতে পেরেছেন। ভোট যাবে ভোট আসবে কিন্তু এমন একজন নেত্রীকে শুধু এই ভোটে কেন সাম্প্রতিক অতীতে আমরা দেখিনি। অন্যান্য রাজনীতিবিদদের থেকে অনেক বেশি উচ্চতায় যে তার অবস্থান তা মানুষ আবার বুঝলো।
দেশের আর কোন নেতার পক্ষেই শারীরিক ও মানসিকভাবে এমন বিস্ময়কর নির্বাচনী প্রচার করা সম্ভব ছিলনা। এখানেও বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনন্যতা আরেকবার প্রমাণিত হল।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত