রাস্তার দিক থেকে ছোড়া ইটটা এসে লেগেছিল ঘাড়ের পাশে। আর কিছুটা উপরে লাগলে মাথার পিছন দিকটা থেঁতো হয়ে যেত। তবু শান্তিদার মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। বিদ্যাসাগর কলেজের নিরাপত্তাকর্মী এই শান্তিরঞ্জন মাহান্তোর উপস্থিতবুদ্ধির জোরেই যে মঙ্গলবার সন্ধেয় বড় রকমের ক্ষতি থেকে বেঁচে গিয়েছেন কলেজে আটকে পড়া পড়ুয়া ও অধ্যাপকরা, তা নিয়ে মোটামুটি একমত ছাত্রছাত্রী ও অধ্যাপকদের বড় অংশ।
বিদ্যাসাগর কলেজের সামনের দরজা দিয়ে ঢুকতে গেলেই প্রথমে পরিচয়পত্র দেখাতে হবে শান্তিদাকে। কাচের কেসের মধ্যে রাখা বিদ্যাসাগরের মূর্তির পাশেই একটা টেবিল নিয়ে বসে থাকেন তিনি। যতক্ষণ কলেজ খোলা, ততক্ষণ তিনিও কলেজে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিধান সরণির দিক থেকে কলেজ লক্ষ করে যখন শিলাবৃষ্টির মতো ইট-পাথর আসছিল, তখন পড়ুয়াদের বাঁচাতে ছুটে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি। কলেজের ছাত্র রঞ্জু গুপ্ত বলেন, ‘হঠাৎ কানে এল শান্তিদা চিৎকার করে সবাইকে ভিতরে যেতে বলছেন। তার পরই দেখলাম একটা ইট লেগে উনি পড়ে গেলেন।’ শান্তির কথায়, ‘ঘাড়ের নীচে ইট লেগে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বুঝেছিলাম, কলেজ অন্ধকার না করে দিলে আমাদের রক্ষা নেই। তাই ছুটেছিলাম মেইন সুইচের দিকে।’ কলেজের অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে প্রথম বর্ষের পড়ুয়া পর্যন্ত প্রত্যেকে ‘শান্তিদা’-র প্রশংসায় পঞ্চমুখ। গোটা কলেজ অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর কোন দিকে কে রয়েছে তার কিছুই বুঝতে পারেনি আক্রমণকারীরা। কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য দেবাশিস কর্মকার বলছেন, “শান্তি না থাকলে ওরা তো আমাকে মেরেই ফেলত। অন্ধকার বলে সুবিধা করতে পারেনি”।
বুধবার দুপুরেই কলেজ পরিদর্শনে আসেন বিদ্যাসাগর কলেজের পরিচালন সমিতির সদস্যরা। পরিচালন সমিতির সভাপতি জীবন মুখোপাধ্যায় ও অন্য সদস্যরা কলেজের অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে যান। পরে জীবনবাবু বলেন, “বৈঠকে আমরা নিন্দা প্রস্তাব আনব। বিদ্যাসাগরের যে মূর্তি চুরমার করে দিয়েছে ওই দুষ্কৃতীরা, সেই মূর্তি নতুন করে তৈরি করা হবে। যেখানে মূর্তি থাকত, খুব তাড়াতাড়ি সেখানেই নতুন মূর্তি বসানো হবে”। প্রশংসায় পঞ্চমুখ কলেজের অধ্যক্ষ গৌতম কুণ্ডু বলেন, “ও যদি বুদ্ধি করে আলো না নেভাত, তা হলে রক্তগঙ্গা বয়ে যেত। ওরা অন্ধকারে দেখতে পায়নি বলে বিল্ডিংয়ের সর্বত্র ঢোকেনি”।
খণ্ডযুদ্ধের পরদিন বিদ্যাসাগর কলেজের ক্যাম্পাসে দিনভর অবস্থানে বসেন ছাত্রছাত্রীরা। মুখে বাঁধা কালো কাপড়। পোস্টারে লেখা ধিক্কার-বাণী। চেয়ারের উপর এনে রাখা হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছবি। মেট্রোপলিটন স্কুল-সংলগ্ন পুরোনো কলেজ ভবনে বুধবার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা নেওয়ার কথা ছিল। কলেজ কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার রাতেই সিদ্ধান্ত নেন কোনও অবস্থাতেই পরীক্ষা বন্ধ করা হবে না। নির্দিষ্ট সময়েই শুরু হয় পরীক্ষা।