বাঙালিকে বর্ণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বাংলার যে মনীষী, প্রায় অর্ধ শতক পর আবারও কলেজপাড়ায় ভাঙা হল তাঁর মূর্তি। তবে ৫০ বছর আগের সেই কালো দিনে যাঁদের বিরুদ্ধে মূর্তি ভাঙার অভিযোগ উঠেছিল, তাঁরা ছিলেন রাজনীতিতে অতি বাম শিবিরে। আর মঙ্গলবারের ঘটনায় অভিযুক্তরা অতি ডান শিবিরের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু ফারাক হল, সেদিনের সেই অতি বামেরা আজ নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত। আর এখনের অভিযুক্তরা তাদের করা ন্যক্কারজনক কাজকে নিজেদের বীরত্ব হিসেবেই দেখছে।
১৯৭০ সালে বিদ্যাসাগরের মূর্তি যাঁরা ভেঙেছিলেন বলে অভিযোগ, তাঁরা এখনও সে দিনের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। তবে কোনও ভাবেই মঙ্গলবারের ‘নৈরাজ্য’ এবং তার পরবর্তীতে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার ঘটনার সঙ্গে সত্তরের উত্তাল সময়ের সেই ইতিহাসকে মিলিয়ে দেখতে রাজি নন প্রাক্তন নকশালপন্থীরা। তাঁদের অনেকেরই মূল্যায়ণ, এই নৈরাজ্য তাঁদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, বছরখানেক আগে ক্ষমতা দখলের পর ত্রিপুরায় লেনিনমূর্তি ভাঙা হয়েছিল একই রকম পেশিশক্তির আস্ফালনের মোহে। সে বারও কাঠগড়ায় ছিল বিজেপি ও তাদের দলবল।
সত্তর দশকে বিদ্যাসাগর-রামমোহন-প্রফুল্ল রায়ের মূর্তি ভাঙার সেই সব স্মৃতি আজও দগদগে প্রাক্তন নকশাল নেতা সন্তোষ রানা, অসীম চট্টোপাধ্যায়, জয়া মিত্র, সুনীশ দেবদের মনন জুড়ে। যুগের হাওয়ায় তাল রাখতে আর বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর সেই সময়ের ছাত্র-যুবদের বয়ানে এখন কেবলই আফশোস। কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগরের মূর্তির মাথা কেটে নেওয়ার আগেও নকশালপন্থীরা ভেঙেছিলেন সংস্কৃত কলেজ ক্যাম্পাসের মূর্তিটি।
সংস্কৃত কলেজের সেই দিনের অপারেশনে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে সুনীশ দেব। তখন তিনি হিন্দু স্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। সুনীশ জানাচ্ছেন, ১৯৭০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রি-মেডিক্যালের ছাত্রছাত্রীরা বেশ কিছু দাবিতে আন্দোলন করেন। উপাচার্যের দপ্তর ঘেরাও হয়। সেখানেই কোনও কারণে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তিটি পড়ে গিয়ে ভেঙে যায়। আন্দোলনরত ছাত্রদের সমালোচনা করে খবরের কাগজে ছবি-সহ প্রতিবেদন বের হয়।
সুনীশের কথায়, ‘এরপরই নকশাল নেতা সরোজ দত্ত দেশব্রতী পত্রিকায় মণীষীদের সমালোচনা করেন এবং এই মূর্তি ভাঙার ঘটনাকে সমর্থন করেন। তার পরই পার্টিলাইন অনুসরণ করে কলকাতা শহর জুড়ে মূর্তি ভাঙার ঘটনা ঘটতে থাকে। তখন কম বয়স, আবেগবশে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার কাজে যোগ দিই। কিন্তু বার বারই মনে হয়েছিল, এ কাজ করে আমরা ভুল করছি।’
সমাজকর্মী সন্তোষ রানা জানাচ্ছেন, সত্তরের দশকে পার্টি লাইন তৈরি হল, কৃষক আন্দোলনে ভূমিকা নেই এমন কোনও মনীষীই আসলে মণীষী নন। সেই অতি বাম উপলব্ধি খুব দ্রুত অপ্রাপ্তিতে অশান্ত হয়ে থাকা যুবদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই ভাবতে শুরু করেন, মূর্তি ভাঙলেই বুঝি বিপ্লব হবে। সন্তোষের কথায়, ‘বছর খানেকের মধ্যেই আমরা পার্টিতে প্রশ্ন তুললাম। তখন যদি পার্টি সেই প্রশ্ন এড়িয়ে না যেত, তা হলে আজ হয়তো এর দায় বয়ে বেড়াতে হত না। কিন্তু মঙ্গলবার শহরে যা হয়েছে, তা একেবারেই ক্ষমতার রাজনীতির দম্ভের ফলে।’
অসীম চট্টোপাধ্যায় তখন ছিলেন গ্রামে। শহরের এই মূর্তি ভাঙার লাইন সেখান থেকেই তাঁরা সমর্থন করেছিলেন। পরে অবশ্য তাঁদেরও একই রকম অনুশোচনা হয়। অসীমের কথায়, তখন আমরা বুঝিনি যে বহুমাত্রিক জীবনে এ ভাবে একরোখা ভাবনা রেখে কাজ করা ঠিক নয়। একটাই ভুল সিদ্ধান্ত এতগুলো বছর আমাদের ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে। এবার যে ঘটনা ঘটল, তা একেবারেই নৈরাজ্য। লাগামহীন অরাজকতার নিদর্শন।