আসানসোল জুড়ে সাম্প্রদায়িক হামলা চলাকালীন ঠিক এক বছর এক মাস আগে সবুজ দেওয়ালে ঘেরা ঘরটায় বসেই খবরটা পেয়েছিলেন নুরানি মসজিদের ইমাম মহম্মদ ইম্মাদুল্লাহ রশিদি। তখনও বোঝেননি তাঁর ১৬ বছরের ছেলে সিবঘাতুল্লা আর ফিরবে না। তবে এতদিন বাদে সেই সবুজ দেওয়ালের ঘর থেকেই ভোট-বুথে যাওয়ার পথে পুত্র হারাবার শোককে বুকে চেপে শান্তির বার্তা শুনিয়েছেন ইমাম। উল্লেখ্য, ভোটের আবহে ফের আসানসোলে তৈরি হয়েছে হিংসার বাতাবরণ। সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ভালবাসা মনে রেখেছি, হিংসা নয়। আমার বিশ্বাস এই ভোটে সেই ভালবাসারই জয় হবে।’
আসানসোলের জাহাঙ্গির মহল্লার গলি তস্য গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে এখন আর মালুম হয় না যে, কোনও এক দিন অশান্তির রাগে পুড়েছে এই পাড়া। সিবঘাতুল্লার দেহ নিয়ে ক্রোধে ফেটে পড়া জনতাকে শান্ত করতে এই ইমামই সেদিন বলেছিলেন, ‘আমার সন্তানের যতটুকু জীবন প্রাপ্য ছিল সে ততটুকুই পেয়েছে। আপনারা অশান্তি না থামালে আমায় এ শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে।’ শহর ছেড়ে যেতে হয়নি ইমামকে। বরং গোটা দেশের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সম্প্রীতির মুখ।
ভোটকেন্দ্রের লাইনে দাঁড়িয়ে সেই ইমাম সোমবার বলেন, ‘এত মানুষ কেন ভোট দিতে এসেছেন জানেন? কারণ এঁরা হিন্দু হোন মুসলিম হোন, দেশটাকে ভালবাসেন। আর এই দেশ বাঁচবে তার দীর্ঘদিনের সম্প্রীতির উপর। ভারত হিন্দু বা মুসলিম রাষ্ট্র হয়ে গেলে এর মৃত্যু অবধারিত।’ আর সিবঘাতুল্লা প্রসঙ্গে ইমাম জানান, সেদিন একটা মিছিল বার হয়েছিল। ওঁরা ধর্মের নামে স্লোগান দিচ্ছিলেন। এক দু’কথায় খবর রটে যায় মিছিলের লোক স্থানীয় দুই মহিলাকে মারধর করেছেন। পাল্টা জাহাঙ্গির মহল্লার কয়েকজন মিছিলের দুই যুবককে আটকে রাখে। এর মধ্যেই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না সিবঘাতুল্লার। আমি আটকে রাখা যুবকদের দ্রুত ছেড়ে দিতে বলি। আমার কথা শুনে ওরা ছেড়েও দিয়েছিল। কিন্তু সিবঘাতুল্লা আর ফেরেনি।
তবে পুত্রহারা এই পিতা পুরনো সেসব কথা মনে রাখতে চান না। তবে স্ত্রী খাদিজাতুলকুব্রাকে এখনও বুঝিয়ে উঠতে পারেননি ইমাম ইম্মাদুল্লাহ। সাত সন্তানের মধ্যে চতুর্থ সিবঘাতুল্লার কথা ভেবে এখনও চোখের জল পড়ে খাদিজাতুলকুব্রার। স্ত্রীয়ের প্রসঙ্গ থেকেই ইমাম মুহূর্তে ফিরে যান সেই রাজনীতিতে। ভোটকেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত আধাসেনা কর্মীর সঙ্গে কথাবার্তার মধ্যেই ইমাম বলেন, ‘বন্যার সময়ে যেমন জলের ওপর আবর্জনা ভাসতে থাকে, জাতপাতের রাজনীতি হচ্ছে সেই আবর্জনা। ভারতে না তালিবান চলবে, না আরএসএস চলবে। ভারত চলবে ধর্মনিরপেক্ষতায়।’
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধেও মুখ খোলেন ইমাম। বলেন, ‘হানাহানি করে ভোটে জেতার দরকার নেই। তিনি বলেছিলেন ১৫ লাখ টাকা করে দেবেন। তার থেকে যদি প্রতি ভারতীয়কে ১৫ হাজার টাকা করেও তিনি দিতেন তাহলে তাঁর দলকে এ ভাবে মারামারি করতে হত না। এমনিই জিততেন।’ তিনি এ-ও বলেন, ‘আসানসোলে অতবড় অশান্তি হল, প্রধানমন্ত্রী কিছুই বললেন না! শান্তি বজায় রাখার পক্ষে আমাদের চেষ্টা নিয়ে তাঁর মুখে কিছুই শোনা যায় না। অথচ, কিছু প্রশ্ন করলে রাষ্ট্রবিরোধী বলে দেন। রাষ্ট্রপ্রেম মানে প্রশ্ন করা বন্ধ করে দেওয়া নয়।’ তবে তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘এ ভোটে ভালবাসার রংই জিতবে।’ তাঁর মতে, ‘প্রতিটি নাগরিকের অধিকার রয়েছে ভোট দেবার। নাগরিক অধিকার পালন করা উচিত। দেশ জুড়ে ঘৃণার বাতাবরণ পিছিয়ে দিচ্ছে দেশকে। মানুষের মধ্য স্বার্থপরতা বাড়ছে। তাই সরকারে যেই আসুক, তারা যেন সহিষ্ণুতার বার্তা দিতে পারে।’