দেশবাসীকে আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখিয়ে, প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছুটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’ নরেন্দ্র মোদী। তবে মোদী জমানার শেষে এসে দেখা যাচ্ছে সেইসব প্রতিশ্রুতিই ছিল আদতে এক একটা জুমলা। বিগত পাঁচ বছরের শাসনপর্বে মোদী সরকারের হতশ্রী পারফরম্যান্স নিয়ে আবারও মুখ খুললেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। বললেন ইউপিএ আমল নিয়েও। তাঁর কথায়, সন্দেহ নেই, বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র কার্যকলাপ মারাত্মক রকম খারাপ, তবে তার ঠিক আগে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকারও যে আহামরি কিছু করেছিল, সে কথাও বলা কঠিন। অবশ্য, কিছু ইতিবাচক কাজ ইউপিএ সরকার সত্যিই করেছিল।
ব্যখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, নজিরবিহীন হারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি যেমন, পাশাপাশি সামাজিক স্তরে কিছু রূপান্তর, যার মধ্যে পড়ছে তথ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ। কিন্তু তাবৎ নাগরিককে, এমনকী নিতান্ত প্রাথমিক স্তরে স্বাস্থ্য পরিষেবাটুকু দেওয়ার কাজে সফল হয়নি ইউপিএ। তা ছাড়া আম্বেদকর যাকে বলেছিলেন, ‘অ্যানাইহিলেশন অফ কাস্ট’, অর্থাৎ জাতপাতের বিনাশ, সেই বাঞ্ছিত গন্তব্যের দিকেও ভারতকে নিয়ে যেতে পারেনি তারা। এনডিএ কী ভাবে ব্যর্থ হল, তা বুঝতে গেলে দুই সরকারের কর্মকাণ্ডের দিকেই সমান দৃষ্টিপাত করা দরকার।
সমস্যাটা হল, ইউপিএ জমানার পরে যে-সব ফাঁক পূরণ করা দরকার ছিল, এনডিএ এসে সে চেষ্টা তো করলই না, উল্টে শূন্যস্থানগুলিকেই দিনকে দিন বাড়িয়ে দিল প্রবল। জাতপাতের অশুভ থাবাকে আরও শ্বাসরোধী করে তুলল তারা। দলিত এবং বঞ্চিত উপজাতি জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা কাটছাঁট করা হল আরও। সকলের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবার বন্দোবস্ত থেকে আরও দূরে চলে গেল দেশ। আর, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে যা বলা হয়েছিল, তার ঠিক উল্টো পথে হেঁটে বেকারত্ব বাড়িয়ে দিল বিষম, দেশের দরিদ্রতর অংশের পক্ষে কাজ পাওয়াটা ঢের কঠিন হয়ে গেল। গত প্রায় অর্ধশতকের মধ্যে ভারতে বেকারির হার শিখর ছুঁয়েছে এনডিএ-র এই জমানায়।
অমর্ত্যর দাবি, শোচনীয় ব্যর্থতার এই তালিকায় আরও একটি সংযোজন দরকার। সাম্প্রদায়িক স্তরে দেশটাকে আরও ভেঙেচুরে দিলেন এনডিএ নেতারা। সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলিমদের জীবনযাত্রা আরও দুর্বিষহ দশায় পৌঁছল। পাশাপাশি, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আমলাতন্ত্রের জালে কী ভাবে কষে বেঁধে ফেলা যায়, সে কাজে বিষম তৎপর হয়ে উঠলেন ভারতের নয়া শাসকবৃন্দ। বাকস্বাধীনতা খর্ব করা হল, ক্ষোভের গায়ে দেশদ্রোহের তকমা এঁটে মানুষজনকে ভরে দেওয়া হল জেলে। সত্যি বলতে, ভারতকে সম্পূর্ণ ভুল একটি দিশায় এগোতে বাধ্য করলেন হিন্দুত্ব-পন্থী শাসকেরা।
এখানেই না থেমে তিনি বলেন, পাশাপাশি আর একটা কাণ্ড হল। সুপরিচিত অর্থনৈতিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না-করে হিন্দুত্ববাদী শাসকেরা ঠিক করলেন একেবারে জাদুবলে উন্নয়ন নিয়ে আসবেন, ‘ডেভেলপমেন্ট থ্রু ম্যাজিক’ -যেমন, দেশভর চালু কারেন্সির একটি অংশকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং পরিভাষায় যাকে ‘প্রমিসরি নোট’ বলে, সেই প্রতিশ্রুতিটি ভেঙে তাঁরা ভাবলেন, দেশে সম্পদ সৃষ্টি করবেন। বুক বাজিয়ে দাবি করা হল, এর ফলে কালো টাকার বিনাশ হবে। বাস্তবে তা তো হলই না, বরং দেশের অগণিত ছোট ব্যবসায়ী এবং উদ্যোগীদের কাজকর্মে ধাক্কা লাগল বিপুল। কৃষিক্ষেত্রও তার ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে পারল না।
তাঁর কথায়, ‘আয়ুষ্মান ভারত’ যোজনায় আধুনিক ওষুধপত্রের ব্যয়ভার বহন করা হবে বলে সরকারি বক্তব্যে অনেক লম্বাচওড়া দাবি করা হয়েছে। এই যোজনায় ব্যয়সাপেক্ষ চিকিৎসা পদ্ধতিতে ভর্তুকি দেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবশ্য সে সব চিকিৎসা মেলে লাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, যারা আবার রোগী ধরার ব্যবসা বাড়াতে রীতিমতো পয়সা খরচ করে এজেন্ট নিয়োগ করে থাকে। কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল, সকলের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুর বন্দোবস্ত করার ব্যাপারে ‘আয়ুষ্মান ভারত’ যোজনায় কোনও লাভই হয় না।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের মতে, দেশের অধিকাংশ নাগরিকের ‘আয়ু’বৃদ্ধির কাজে যত্নবান না হয়ে (অর্থাৎ, সকলের কাছে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিতান্ত হাত গুটিয়ে থেকে) কিছু মানুষের ‘আয়ু’বৃদ্ধিতে অগ্রাধিকার দেওয়া (অর্থাৎ, লাভজনক বেসরকারি উদ্যোগে ঢালাও সাহায্য প্রদান) বাস্তবিকই একটি ভুল। ইউপিএ সরকারের উপরে এই অবহেলার কিছু দায় বর্তায় ঠিকই, তবে এনডিএ সরকারের কার্যক্রম দেখে মনে হয়, ভারতের এই মুহূর্তে যা যা প্রয়োজন, সে-সবের পাটই এখন দেশ থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে।