মানুষের মমতা
সামান্য হাওয়াইতেই সব হাওয়া! বুট, মোকাসিন, নাগরা, স্যান্ডাল, স্নিকারস, চটি, হিল, হাইহিল কেউই এঁটে উঠতে পারছে না বাংলার উত্তর থেকে দক্ষিণ ঝড়ের গতিতে ছুটে চলা হাওয়াইয়ের সামনে। গত তেসরা এপ্রিল থেকে নির্বাচনী প্রচারে যারা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আছেন তাদের সবাইকেই এই হাওয়াই যেন হাঁফ ধরিয়ে দিয়েছে। সফর যত দীর্ঘতর হচ্ছে ততই যেন বাড়ছে হাওয়াই ঝড়। আগে ছিল দিনে দু-তিনটে মিটিং এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দিনে প্রায় ৪ থেকে ৭ কিলোমিটার পদযাত্রা। মুখ্যমন্ত্রীর প্রচারের একেকটা দিন শুরুর ব্যাপারটা আমরা জানতে পারি কিন্তু তার কর্মসূচী কোথায় শেষ হবে তা জানা অসম্ভব। আমি তো বটেই, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সফররত সাংবাদিকরাও তার গতির সঙ্গে তাল রাখতে পারছেন না। দীর্ঘ ৪০ বছরের সাংবাদিক জীবনে নেতা-নেত্রী কম দেখিনি, কিন্তু দিদি একেবারে অন্যরকম। বনগাঁ থেকে বাকিংহাম প্যালেস, দার্জিলিং থেকে দেগঙ্গা সর্বত্রই তার পায়ে সেই হাওয়াই। মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে ভাবি এ তো সেই রূপকথার গল্পে পড়া জুতোর মত, যা পরে যেকোন সময় ঝড়ের গতিতে সর্বত্র পৌঁছে যাওয়া যায়।
আজ শান্তিপুরেও মিটিং, পদযাত্রায় ঝড় তুললেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে তার প্রচারের প্রথমদিন থেকেই লক্ষ্য করছি প্রতিদিন যেন তার প্রচারের গতি এবং সময় বাড়ছে। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে মানুষের ভিড়। এই ভিড়ের কোন বয়স নেই, ৮ থে ৮০ সবাই তাকে দেখতে, ছুঁতে, কথা বলতে ভিড় করছেন। দিদিও যতটা সম্ভব তাদের অনুরোধ রাখার চেষ্টা করছেন। তার সঙ্গী সাংবাদিক, সিকিওরিটি, প্রশাসন সময়সময় যেন এই জনজোয়ারের ধাক্কায় দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। কর্মসূচী যত এগোচ্ছে তত বাড়ছে তাকে ঘিরে উন্মাদনা।
প্রখর রৌদ্রে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পরপর নির্বাচনী জনসভা, পঞ্চাশ মিনিট থেকে দেড়ঘন্টা ভাষণ, পদযাত্রা, তারপরেও তার সাংগঠনিক ব্যস্ততা থামে না। স্টেজে উঠে এক ভাঁড় চা ছাড়া আর কিছুই খান না, ডাব থাকে কিন্তু আমি কোনদিন খেতে দেখিনি। এই দাবদাহ অগ্রাহ্য করে বাংলার ৪২টি আসন মাথায় রেখে একের পর এক সভা করে যাচ্ছেন তিনি। কেউ বলতেই পারেন এত শক্তি উনি পান কোথা থেকে? আপাতদৃষ্টিতে প্রশ্নটা কঠিন হলেও উত্তরটা কিন্তু সহজ। মালদার ইংরেজ বাজারে পদযাত্রার সময় দেখছিলাম, বিজেপি অফিস থেকে কিছু মানুষ যাদের বেশিরভাগই মহিলা, মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে হাত নাড়ছেন। এরা তার সমর্থক নন কিন্তু দিদি সম্পর্কে কৌতূহল, ঔৎসুক্য, তাকে দেখার ইচ্ছে তাদেরকে টেনে এনেছে। কাজের ঝড়ে, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় দেশে সব নেতাকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন তিনি। মানুষই তার শক্তির উৎস।
দীর্ঘদিন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কর্মসূত্রে থাকার সুবাদে লক্ষ্য করেছি পছন্দ করুন বা না করুন মানুষ তাকে দেখা বা কথা বলার আগ্রহটা দমন করতে পারেন না। আজও শান্তিপুরের পদযাত্রার সময় দেখছিলাম সবাই তাকে দেখতে চান, ছুঁতে চান। এই চাহিদার কোন বয়স নেই, নারী-পুরুষ কোন ভেদাভেদও নেই। আমার মনে হয় জনপ্রিয়তার নিরিখে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সামনে এই মুহূর্তে দেশের কোন নেতা-নেত্রী দাঁড়াতে পারবেন না। রাস্তায় তাকে একবার স্বচক্ষে দেখার জন্য দীর্ঘক্ষণ মানুষ দাঁড়িয়ে থাকেন, বিশেষ করে মহিলারা। মায়েরা দাঁড়িয়ে থাকেন তাদের শিশুটিকে কোলে করে, তার কাছে আবদার করেন তার শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করার জন্য। এখানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডিঙিয়ে যান চেনা রাজনীতির সীমানা।
এই অক্লান্ত পরিশ্রমই তার সম্পর্কে মানুষের কৌতূহল বাড়িয়ে তুলে ব্র্যান্ড মমতার জন্ম দিয়েছে। আমি কারও সঙ্গে তার তুলনা করছি না। গান্ধীর যেমন চশমা লাঠি; ইন্দিরা বলতে যেমন মনে পড়ে মাথার কালো চুলে একপশলা রুপোলী ঝলক তেমনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেই মনে ভেসে ওঠে হাওয়াই চটি পায়ে দ্রুত হেঁটে যাওয়া সদাতৎপর এক অকুতোভয় নেত্রী। শুধু ভারতবর্ষ কেন সারা বিশ্বের কোন নেতা এই চটি পায়ে সবসময় ঘোরেন কিনা আমার জানা নেই। দেশবিদেশ, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সবসময় হাওয়াই তার ভরসা।
তার মধ্যে আমি দেখি বাপুর নিষ্ঠা ও নিরাভরণ জীবনযাপন আর ইন্দিরার সাহস। বাপু যেমন একা হাঁটতে শুরু করলে তার পিছনে মানুষের ঢল নামতো, দিদির পদযাত্রার সময়েও একই ঘটনা ঘটে। ইংলিশবাজারে দেখেছিলাম দিদি হাঁটতে শুরু করতেই দলে দলে মানুষ তার পিছনে হাঁটতে শুরু করলেন। আজকে শান্তিপুরের পদযাত্রায়ও একই ঘটনা ঘটল। এসব কিন্তু কোন পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী নয়। তাকে দেখেই মানুষের ঢল নামছে।
দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বদানের স্বাভাবিক ক্ষমতা তাকে জননেত্রী করে তুলেছে। এই কদিন প্রচারে তার সঙ্গে থাকতে থাকতে আরেকটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি তার সাদামাটা জীবনযাপন, কথাবার্তা, বেশভূষা এবং হাওয়াই মানুষকে দিন দিন তার প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট করে তুলছে। আবার মানুষকে দেখলে মুখ্যমন্ত্রীও যেন উদ্বেল হয়ে ওঠেন। বিধিনিষেধের ঘেরাটোপ পেরিয়ে চলে যেতে চান তাদের কাছে। মুখ্যমন্ত্রীর এবারের নির্বাচনী সফরের এই কদিনের অভিজ্ঞতা আমায় বলছে মানুষ এবারও তাদের প্রিয় দিদিকে ফেরাবেন না।
প্রথম দিকে দিদির হাওয়াইয়ের স্ট্র্যাপ ছিল নীল, এখন তা সাদা। সাদা শান্তির প্রতীক, সাদা মানে স্বচ্ছতা। বিজেপি ধর্মের নামে দেশে হিংসা, বিভেদ, অশান্তির যে অন্ধকার রাজনীতি চাপিয়ে দিতে চাইছে, হাওয়াই হাওয়াতে তা উড়ে যাবে। রাজনীতিতে ফিরবে শান্তি ও স্বচ্ছতা।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত