প্লট তুমি কার? এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি শিবিরের অস্বস্তি বাড়াতে এই প্রশ্নই তুলছেন বিরোধীরা। শুধু তাই নয়, ইতিমধ্যেই সে প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে আসরে নেমে পড়েছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমও। পরিস্থিতি এমনই যে, এখন এ কথা বলাই যায়, যে কোনও রহস্য-কাহিনির প্লটের থেকেও রােমাঞ্চকর গুজরাতের গান্ধীনগরের সেক্টর ১, প্লট নম্বর ৪০১/এ-র গল্প। তবে তার গৌরচন্দ্রিকা হিসেবে অবশ্য আরও একটি প্লট আছে। ওই গান্ধীনগর সেক্টর ওয়ানের প্লট নং ৪১১।
নরেন্দ্র মোদী যখন ২০০৭ সালের ভোটের মনোনয়নপত্র জমা দেন, নিয়মমাফিক হলফনামায় জানিয়েছিলেন যে, তিনিই ওই ৪১১ নং প্লটের একমাত্র মালিক। কিন্তু পরের দুটি নির্বাচনে ২০১২ এবং ২০১৪ সালে মােদীর জমা দেওয়া হলফনামা থেকে নিঃশব্দে উধাও হয়ে যায় প্লট নং ৪১১! মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রতি বছর তাঁকে যে হলফনামা দিতে হয় পিএম ইন্ডিয়া ওয়েবসাইটে, সেখানেও এই সরকারি জমিটির কোনও উল্লেখ নেই। যদিও গান্ধী নগরের ভূমি রাজস্ব দফতরের রেকর্ড অনুযায়ী, এখনও ওই জমির মালিক নরেন্দ্রভাই দামােদর দাস মােদী।
কৌতুহল হতেই পারে যে, ২০০৭ সালে একবার উল্লেখ করার পর থেকে ওই তথ্য কেন মোদী গোপন করেছেন? কারণ, তা না হলে কেউ প্রশ্ন করতে পারত, কীভাবে তিনি ওই জমির মালিকানা হাসিল করেছেন? গান্ধীনগরের সব থেকে বর্ধিষ্ণু ও পয়লা নম্বর সেক্টরে রাজ্য সরকারের বদান্যতায় জমি পেতে পারেন একমাত্র গুজরাটের সাংসদ, বিধায়ক এবং পদস্থ সরকারি কর্মীরা। সেই নিয়মে মােদীর ওই জমি পাওয়ার কথাই নয়।
কারণ, ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্টে গুজরাতের সরকারি জমি সংক্রান্ত এক মামলায় রাজ্যের বিজেপি নেত্রী মীনাক্ষী লেখি, যিনি তখন গুজরাতের সরকারি কৌঁসুলি ছিলেন, হলফনামা দিয়ে সর্বোচ্চ আদালতকে জানিয়েছিলেন— ২০০০ সালের পর থেকে গুজরাত সরকার কাউকে কোনও সরকারি জমি দেয়নি। তা হলে মােদী ৪১১ নং প্লটের মালিক হলেন কী করে? তিনি তো গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হয়েইছেন ২০০১ সালে এবং রাজকোট-২ কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জিতে বিধানসভায় গেছেন ২০০২-এর ফেব্রুয়ারিতে!
২০০৭ সালের হলফনামায় মোদী কিন্তু নির্দিষ্ট ভাবে জানিয়েছেন , ৩২৬.২২ বর্গ মিটার আয়তনের ৪১১ নং প্লটটি তিনি ১.৩১ লাখ টাকা খরচ করে কিনেছেন, যে প্লটের বাজারদর এখন ১.১৮ কোটি টাকা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেন গান্ধীনগরে ওই সেক্টর ১
গুজরাতের বিজেপি নেতাদের এত আদরের। মােদী ছাড়াও
এখানে জমি আছে অরুণ জেটলি, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, গুজরাতের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী প্রয়াত জনা কৃষ্ণমূর্তির। কিন্তু বিধায়ক, সাংসদ বা সরকারি কর্তা না হয়েও মােদীর নাম মালিকদের তালিকা কীভাবে ঢুকেছিল, তা জানতে উৎসাহী হয়ে ওঠে সংবাদমাধ্যম। যা হয়েছিল মােদীর স্নাতক ডিগ্রির খোঁজ নেওয়ার ক্ষেত্রে।
তবে কোথাও কোনও রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি। গান্ধীনগর জেলাশাসকের, ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরের সাব-রেজিস্ট্রার, জেলাশাসকের অধীন যে বিভাগ সরকারি জমির মালিকানা সংক্রান্ত নথিপত্র সংরক্ষিত রাখে, সেই মামলাতদারের দফতরেও কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি প্লট নং ৪১১ এবং তার মালিক সম্পর্কে। কিন্তু এই রহস্য-কাহিনী মূল প্লট আসলে ৪১১ নয়, ৪০১/এ। ২০১২ সালের নির্বাচন থেকে প্রতিটি হলফনামায় যে-জমির এক-চতুর্থাংশের মালিক নরেন্দ্র মােদী।
একই প্লট নম্বর আবির্ভূত হয়েছে আরও একজনের হলফনামায়। তিনিও নাকি এক-চতুর্থাংশের মালিক। যদিও গান্ধীনগরের জমির খতিয়ানে তাঁকেই দেখানো আছে ৪০১ নং প্লট একমাত্র মালিক হিসেবে। তিনি প্রধানমন্ত্রী মােদীর বিশ্বস্ত অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। আর বাস্তবে বা নথিপত্রে ৪০১/এ প্লটের কোনও অস্তিত্ব নেই। কিন্তু মোদী সেই প্লটের নিখুঁত হিসাব দিয়েছেন তার হলফনামা এবং ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে পিএম ইন্ডিয়া ওয়েবসাইটে দেওয়া বিষয়-সম্পত্তি বিষয়ক তথ্য। ৪০১/এ প্লট আয়তনের ১৪,১২৫.৮০ বর্গফুট বা ১৩১২.৩ বর্গমিটার, যা কিনা গান্ধীনগর সেক্টর ওয়ান বাদবাকি প্লটের তুলনায় প্রায় চার গুণ।
মোদী জানিয়েছেন, তাঁর অংশ হল ৩৫৩১.৪৫ বর্গফুট বা ৩২৮.০৮ বর্গমিটার। যার আনুমানিক বাজারদর ১ কোটি টাকা। সেই জমিতে নির্মাণকাজের জন্য তাঁর ২.৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছিল, সে হিসেবও দিয়েছেন মোদী। অন্যদিকে, অরুণ জেটলি ২০০৬ সালের ভোটের হলফনামায় জানিয়েছিলেন, তিনি গান্ধীনগর সেক্টর ওয়ানের ৪০১ নং প্লটের মালিক। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের হলফনামা এবং ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর ওয়েবসাইট পিএম ইন্ডিয়া-তে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে জেটলির দেওয়া তথ্যে কিন্তু ৪০১ নং প্লটের আর কোনও উল্লেখ নেই। তার বদলে আছে ওই অস্তিত্বহীন ৪০১/এ প্লটের এক-চতুর্থাংশের মালিকানার কথা।
যদিও এখনও খাতায়-কলমে জেটলিই ৪০১ নং প্লটের মালিক, যেমন ৪১১নং প্লটের মালিকানা নথিভুক্ত মােদীর নামে। কিন্তু দুজনের কেউই হলফনামায় সেই মালিকানার উল্লেখ করেননি। সম্প্রতি এই নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন সাকেত গোখেল নামে এক প্রাক্তন সাংবাদিক, যিনি এখন জনসংযােগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বাধীনভাবে কাজ করেন। ওই মামলার সূত্রেই জানা যাচ্ছে গান্ধীনগর ৪০১/এ প্লটের রহস্য।
এর মধ্যে সাংবাদিকরা সরেজমিনে ঘুরে দেখতে গিয়েছিলেন গান্ধীনগর সেক্টর ১ এবং ৪১১ নং প্লট, যার মালিকানা প্রধানমন্ত্রী এখন গোপন করতে চান। তবে সেক্টর ওয়ানে বিরাট জায়গা জুড়ে বানানো অতিকায় বিলাসবহুল বাংলো বাড়িগুলোর মধ্যে ৪০১ অথবা ৪১১, কিংবা ৪০১/এ প্লটগুলো আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারেননি সেই সাংবাদিকরা। কিন্তু ৪১০ নং প্লটের বাংলো বাড়ির লাগোয়া, পাঁচিল ঘেরা একটি জমি তারা দেখতে পান, যা সাধারণ প্লটের মাপের অন্তত চার গুণ।
সেই পাঁচিলের মাঝে তালাবদ্ধ ফটকের গরাদের ফাঁক দিয়ে একটু উকিঝুঁকি মারতেই হাজির হন এক ব্যক্তি, যিনি সাংবাদিকদের জেরা করতে শুরু করেন। পরিচয়পত্র দেখতে চান। তার পর পুলিশকে ফোন করে বলেন, কিছু উটকো লোক ‘সাহেব’-এর বাংলো দেখতে এসেছে। এর পরই এক সাংবাদিকের ফোনে অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে। নিজেকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে একজন খুব কর্কশ গলায়, প্রায় ধমকের সুরে ওঁদের বলেন, গান্ধীনগরে খবর সংগ্রহ করতে আসার আগে স্থানীয় থানায় জানানো উচিত ছিল। এর পর ফিরে আসেন সাংবাদিকরা, প্লট নং ৪১১ আর অস্তিত্বহীন ৪০১/এ প্লট রহস্যের কোনও সমাধান না করেই। তবে ওই ঘটনার পরই উদয় হয়েছে আরেকটি প্রশ্ন, ওই ‘সাহেব’ আসলে কে? জেটলি, নাকি স্বয়ং মোদী? তবে প্লটের মতোই এখনও অধরা সেই ‘সাহেব’-এর পরিচয়।