সমাজবিরোধীদের জন্য তৃণমূলে জায়গা নেই। এ কথা বারবারই বলেছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ জন্য একাধিকবার একাধিক জনকে ছেঁটেও ফেলেছে দল। তেমনি নিশীথ প্রামাণিককেও কয়েক মাস আগে সমাজবিরোধী কাজের জন্য তৃণমূল থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল। আর সুযোগ বুঝে তারপরই তাঁকে দলে টেনে নিয়ে ভোটের টিকিট দেয় বিজেপি। উদ্দেশ্যে, এক সমাজবিরোধীর মাধ্যমে জেলার বাসিন্দাদের চমকে ধমকে ভোটে জেতা। কিন্তু তা হতে না দিয়ে, বিজেপিকে রুখে দিতে চায় মমতার দল।
‘এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা দইরার (নদীর) পানি/খোদা তোমার মেহেরবানি’। ১৯৩৯ সালের ৫ আগস্ট কলকাতার বেকার হলে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা এই ভাওয়াইয়া গেয়েছিলেন আব্বাসউদ্দিন। কোচবিহার কলেজের ছাত্র। তিনি বলতেন, আমার শ্রোতা গ্রামের করিমুদ্দি, বলাই মিয়াঁ, সর্বেশ্বর দাস, পেনকেটু বর্মন। এই শ্রোতাদের জন্য তিনি গাইতেন ‘ওঠ রে চাষি, জগৎবাসী, ধর কষে লাঙল’। কিন্তু এবার সেই কোচবিহারকেই হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করার চেষ্টায় ভোটের ভাওয়াইয়া গাইছে নরেন্দ্র মোদীর দল। জেলায় কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট যখন নীরব দর্শকে। সেসময় এটা রোখার সাহস ও জেদ দেখাচ্ছে একমাত্র তৃণমূলই।
ভোটের আগে তুফানগঞ্জ, মাথাভাঙা, দিনহাটা ঘুরে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, তৃণমূল প্রার্থী পরেশ অধিকারীর জয় নিয়ে কারও মনে কোনও সংশয় নেই। এলাকার ছোট দোকানদার, টোটোচালক, হকার, শিক্ষক একটু ইতস্তত করে স্পষ্ট বলছে, সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক, কংগ্রেসকে দিতাম, এবার দেব বিজেপি–কে। কারণ, আমাদের লোক জিতবে না। জিতলেও কিছুই করতে পারে না! আর বিজেপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক নিশীথ প্রামাণিক কখনও কাজে যান না। দিনহাটার পথে নিজের এলাকায় গতবার কয়েক কোটি টাকা খরচ করে গণেশ পুজো করেছেন তিনি। আর এখন ওয়াই ক্যাটেগরির কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা নিয়ে ঘুরে বেড়ান।
প্রসঙ্গত, পুরনো কোচবিহার রাজ্যের কিছুটা অংশ ছিল অসম ও বাংলাদেশের মধ্যে। এখন মানুষের কথ্য ভাষায় সেই টান আছে। কিন্তু সম্প্রতি অমিত শাহের ভাষণে প্রবলভাবে মুসলিম বাঙালি খেদানোর আতঙ্ক ছড়িয়েছে এলাকায়। বিজেপির আশা, আতঙ্কিত মানুষ দুর্বৃত্তকে যেমন ভজনা করে, তাদেরও করবে। কেউ কেউ বলছেও, ওরা তো হিন্দু ভিনদেশিদের সব সময় শরণার্থী বলছে। যে কারণে চিন্তা বাড়ছে কোচবিহারবাসীর। শুধু কোচবিহার শহরে চার হাজার টোটোচালক, বেশির ভাগই বাঙালি মুসলমান কিংবা পূর্ববঙ্গ থেকে আগত। তবে তাঁরা স্বীকার করছেন, দিদির আমলে হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসা পাচ্ছেন প্রত্যেকেই।
উল্লেখ্য, আজ দলিত সমাজের উন্নয়ন নির্বাচনে সবাই হাতিয়ার করে। কোচবিহারের সবচেয়ে বড় দলিত রাজবংশী। একশো বছর আগে রায়সাহেব পঞ্চানন বর্মা রাজবংশী উচ্চশিক্ষিত হয়ে এই সমাজকে উন্নত করার চেষ্টা করেন। তখন হরিশ্চন্দ্র পালের মতো উচ্চবর্ণের কোনও কোনও বাঙালি তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। পঞ্চানন বর্মার নামটা একটা মঞ্চ এবং একটা কলেজের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে বাম সরকার শ্রদ্ধা চুকিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই তৃণমূল সরকার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয় গড়েছে। জেলায় একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে রাজবংশীদের ব্যাপারে বিশেষভাবে চর্চার ব্যবস্থা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ দেবকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, রাজশাহি, ঢাকা এবং গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কিছু কাজ হচ্ছে। এ ব্যাপারে এশিয়াটিক সোসাইটি সাহায্য করছে। আসলে ভাঙা নয়, জোড়া লাগানোই এখানে তৃণমূল সরকারের লক্ষ্য। তাই তৃণমূল নেত্রী দিনহাটা, মাথাভাঙা— সর্বত্রই জোরের সঙ্গে বলতে পারেন, প্রার্থী নয়, ভোট দিন আমাকে দেখে। তাই এবারও যে এখানে তৃণমূল প্রার্থী পরেশ অধিকারী বিপুল ভোটে জিতবেন, তা নিয়ে কোনও সংশয়ই নেই জেলার বাসিন্দাদের।