কেশরী শুনে প্রথমে ভেবেছিলাম গুঠখার বিজ্ঞাপন, তারপর দেখলাম অক্ষয় কুমার ওরফে কানাডা কুমারের নতুন ছবি। যিনি নিজে ভারতের নাগরিকত্ব ছেড়ে কানাডার নাগরিকত্ব নিয়েছেন আর আপনাকে মাঝে মাঝে দেশভক্তির সরবৎ খাওয়াতে আসেন।
রেশমপথ, যা ছিল তৎকালীন মধ্যপ্রাচ্য হয়ে সমগ্ৰ ইউরোপ ও আফ্রিকার সাথে যোগাযোগ ও ব্যবসার সুবর্ণরেখা। রেশমপথ যার দখলে, ব্যবসা তার। তাই বারে বারে বিদেশী আক্রমণ হতো এই পথ দখলের জন্য এবং আফগানরা নিজভূমি রক্ষার জন্য বারে বারে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়তো।
ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি এবং পরবর্তীকালে ব্রিটিশ রাজের সময়ও এই লড়াই চলেছে, যার একটি ক্ষুদ্র অংশ উঠে এসেছে কেশরী সিনেমায়। পেশোয়ারের খুব কাছে সরাগড়িতে ২১ জন বীর শিখ যোদ্ধা প্রায় ১০০০ জন আফগানের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। শিখরা যে বীরের জাত সে আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তারা লড়েছিলেন ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর হয়ে স্বাধীন আফগানদের বিরুদ্ধে। একদিকে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার ও দখল অন্য দিকে নিজ মাতৃভূমির রক্ষার লড়াই। সিনেমার মাঝে বেশ কিছু দেশপ্রেমের বুলি আওড়ানো হয়েছে যা আপনার ঘিলু ধোয়ার জন্য যথেষ্ট। শিখদের জাতীয়তাবাদ নিয়েও রয়েছে গরম গরম ডায়লগ। এই সবই কিন্তু হচ্ছে ইউনিয়ন জ্যাকের তলায়। এখন নিজেই ভাবুন, এক্ষেত্রে এই যুদ্ধের সাথে আমাদের রাষ্ট্রপ্রেমের কী সম্পর্ক?
সম্পর্ক রয়েছে। ব্রিটিশ-আফগান এই যুদ্ধকে হিন্দু-মুসলমান মোড়কে মুড়ে, নায়কের মাথায় গেরুয়া রঙের পাগড়ী পড়িয়ে “কেশরী” নাম দিয়ে এক নতুন রাষ্ট্রপ্রেম স্থাপনের প্রচেষ্টা চলছে। পরমাণু, উরি আর এবার কেশরীর মতো বলিউড কন্টেট ধরে দুফোঁটা পোলিও ড্রপের মতো আপনাকে নতুন রাষ্ট্রপ্রেমের ড্রপ খাওয়ানো হচ্ছে।
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় নেতাজী যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে এগোচ্ছেন তখন আর.এস.এস নেতারা ব্রিটিশ সৈন্য বাহিনীর জন্য রিক্রুটমেন্ট করত। তাঁরা বোঝাতো যে মুসলমানদের হাত থেকে হিন্দুদের বাঁচাতে একমাত্র ব্রিটিশরাই পারে আর তাই ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেওয়া উচিৎ ও ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত থাকা উচিৎ। বহুকাল আর.এস.এস ভারতের রাষ্ট্রীয় পতাকাকে মান্যতা দিত না। আজ তারা নিয়ে এসেছে রাষ্ট্রপ্রেমের নতুন সংজ্ঞা। সেই পুরোনো ব্যাপার নতুন রাংতার মোড়কে। যা আপনার চোখ ঝলসে দেবে আর কয়েক বছরের মধ্যেই প্রমাণ করে দেবে সুভাষ ছিলেন জাপানি দালাল আর আপনি ভাববেন এই গণতন্ত্র আপনার এবং আপনার ভোটেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
এই যে ভোটের প্রাক্কালে মুসলিম শিখ বিভাজন ছড়ানোর প্রয়াস, এটা যে কত ভুয়ো, তার পরিষ্কার হয় যখন আমরা দেখি যে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ কিন্তু তাদের ভাড়াটে বাহিনী তৈরী করতে প্রচুর সংখ্যক পাঞ্জাবি শিখের পাশাপাশি, প্রচুর সংখ্যক পাঞ্জাবি মুসলমানকেও নিয়োগ করেছিল। জাতীয়তাবাদ নয়, ধর্ম নয়, ভাড়াটে বাহিনীর উদ্দেশ্য হয় টাকা আর তাদের নিয়োগকর্তা ইংরেজের লক্ষ্য লুঠ ও সাম্রাজ্য বিস্তার। এবং শিখ ও মুসলমান পাঞ্জাবি ভাড়াটে সৈন্যরা পাশাপাশি লড়ে ইংরেজের স্বার্থে কত কালো মানুষের দেশ, ঠিক আমরা যেমন দখল হয়েছিলাম। আজ ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়ে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। উপমহাদেশে বহিরাগতদের লুঠ ও বিস্তার থেকে তৈরি হচ্ছে বীরগাথা। এ তো সুভাষ, বাঘাযতীন, সূর্য সেনের অপমান! ব্রিটিশদের ভাড়া করা কেউ আমাদের, অন্ততঃ বাঙালীদের বীর নয়। আমাদের বীরেদের নাম লেখা আছে আন্দামানের সেলুলার জেলে। আজ ইংরেজদের কাছে ক্ষমা চেয়ে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পাওয়া সাভারকরের আদর্শের বিজেপি আরএসএস ও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বলিউডি বেওসায়ি পুঁজি বাঙালীকে, বারো ভুঁইয়ার জাতিকে, মাতঙ্গিনী হাজরার জাতিকে বীরত্ব শেখাতে এসেছে। সাহস কত!