প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হওয়ার পরেই বিজেপি কর্মীদের অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। কোচবিহার, বসিরহাট, মালদহ, জলপাইগুড়ির ঘোষিত বিজেপি প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সরব হন বিজেপির সাধারণ কর্মী-সমর্থকেরা। এলাকায় পড়েছে পোস্টার, ব্যানার। সেই প্রার্থী জট সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন দিলীপ ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানি। এসবের মধ্যেই বিজেপির সামনে নতুন সমস্যার উদয় হয়েছে। দল কিছু ঘোষণা করার আগেই একজন নেমে পড়েছেন ভোটের প্রচারে, নিজেকে একটি কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরে।উত্তরবঙ্গের এক আসনে মন কষাকষি শুরু হয়ে গিয়েছে বিজেপি এবং সঙ্ঘের মধ্যে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিশেষ বৈঠকে দলকে রীতিমতো ধমক দিয়েছেন নেতৃত্ব। শৃঙ্খলা ভাঙলে কঠোর পদক্ষেপ-হুঁশিয়ারি দিয়েছেন খোদ সাধারণ সম্পাদক।
প্রথম ঝড়টা ওঠে কোচবিহারে। কয়েকদিন আগে বিজেপি-তে যোগ দেওয়া নিশীথ প্রামাণিক কেন কোচবিহারের বিজেপি প্রার্থী? এই প্রশ্ন তুলে জেলা পার্টি অফিসে তুমুল বিক্ষোভ শুরু করেছিলেন বিজেপি কর্মীদের একাংশ। পরিস্থিতি সামলাতে দিল্লীর দূত অরবিন্দ মেনন পৌঁছে যান কোচবিহারে। দফায় দফায় বৈঠক করে অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু মন থেকে কি নিশীথের হয়ে ময়দানে নামতে পারবেন বিজেপির দীর্ঘ দিনের কর্মীরা? সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
হবিবপুরের দীর্ঘ দিনের সিপিএম বিধায়ক খগেন মুর্মুকে উত্তর মালদহে পদ্মফুলের টিকিট দেওয়া হতে পারে, এই খবর ছড়াতেই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। খগেনের বিরোধিতা করে আগাম পোস্টার পড়েছিল গাজোলে। বিজেপি নেতৃত্ব সে সবে পাত্তা দেননি। খগেনের নামই প্রার্থী হিসেবে ঘোষিত হয় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। তার পরে উত্তর মালদহের অন্যান্য এলাকাতেও ফ্লেক্স ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে খগেন মুর্মুকে প্রার্থী হিসেবে মানতে না চেয়ে। বসিরহাটেও ফ্লেক্স ঝোলানো হয়েছে কয়েকটি এলাকায়। সায়ন্তন বসুকে ‘বহিরাগত’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে সেই ফ্লেক্সে।
প্রার্থী নিয়ে অসন্তোষ এবং সেই সংক্রান্ত বিশৃঙ্খলার আঁচ পাওয়া গিয়েছে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে আয়োজিত বিশেষ বৈঠকেও। দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন আসনে যাঁরা প্রার্থী হয়েছে, তাঁদের সঙ্গে দলের বিভিন্ন স্তরের কার্যকর্তাদের আলাপ করিয়ে দিতেই ওই বৈঠক ডাকা হয়েছিল। জানা গেছে, সেখানেই প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত চেয়ারে গিয়ে বসে পড়েন অর্চনা মজুমদার নামে এক নেত্রী। কে এই অর্চনা? তিনি পেশায় চিকিৎসক। অসরকারি সংগঠন চালান। মুকুল রায়ের অনুগামী হিসেবেই তাঁর পরিচিতি। মুকুলের নিজের জেলা নদিয়া থেকেই অর্চনা প্রার্থী হতে পারেন বলে বেশ কিছু দিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। যদিও রাজ্য নেতৃত্বের একাংশও অর্চনাকে প্রার্থী করতে একেবারেই রাজি ছিলেন না। কিন্তু অর্চনা মজুমদার কোনও ঘোষণার অপেক্ষা না করে নিজেই প্রচারে নেমে পড়েছেন বলে নদিয়ার বিজেপি নেতাদের একাংশ দাবি করছেন।
আবার বালুরঘাটের বিজেপি প্রার্থী সুকান্ত মজুমদারকে পেয়ে জেলা নেতৃত্ব একেবারেই খুশি নন বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুকান্ত আরএসএস ঘনিষ্ঠ। জেলা বিজেপির কর্মীরা জানাচ্ছেন, দক্ষিণ দিনাজপুরের রাজনীতিতে বিজেপির মুখ হিসেবে পরিচিত যাঁরা, তাঁদের মধ্যেই কাউকে টিকিট দেওয়া হবে বলে অনেকে আশা করেছিলেন। কিন্তু তার বদলে সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে প্রার্থী করা হয়েছে বলে অনেকে অসন্তুষ্ট। সেই অসন্তোষের ছাপও পড়তে শুরু করেছে। প্রার্থী ঘোষণার পরে তিন দিন কেটে যাওয়া সত্ত্বেও বালুরঘাটের মতো জায়গায় বিজেপি এখনও সংগঠিত ভাবে প্রচারেই নামতে পারেনি।
বিজেপির মতো সংগঠিত কাঠামোর দলে নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ সাধারণত হয় না। কিন্তু সেই বিরল ঘটনাটাই রাজ্যের নানা প্রান্তে ঘটছে। কোচবিহারে কী ঘটেছে, তা গোটা বাংলা এখন জানে। সমস্যা অত্যন্ত জটিল আকার না নিলে অরবিন্দ মেননের মতো সর্বভারতীয় স্তরের নেতাকে যে তড়িঘড়ি কোচবিহার ছুটতে হত না, সে কথা বুঝে নিতে কারও বাকি নেই। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে বাংলার ৪২টি আসনের মধ্যে ২৮টি আসনের জন্য প্রার্থী ঘোষণা হতেই এই অবস্থা। বাকিদের নাম ঘোষণা হওয়ার পরে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
