বাংলার ঐতিহ্য হল লোকসংস্কৃতি। ক্ষমতায় এসেই বাম জমানায় প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতিকে আবারও পুনরুজ্জীবিত করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মাওবাদী অস্থিরতার দিনগুলোয় লোকসংস্কৃতির চর্চাই হারিয়ে গেল ঝাড়গ্রামের জঙ্গল মহলে। রাজ্যে পালাবদলের পর তৃণমূল সরকার আসতেই মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে ঝাড়গ্রামের জঙ্গল মহলে শান্তিও ফিরে আসে। ধীরে ধীরে ফের শুরু হল হারিয়ে যাওয়া মাটির সংস্কৃতির চর্চা। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর সন্ধ্যায় যেখানে চলত লোকসংস্কৃতির চর্চা, সেখানে খোদ মমতার তথ্য সংস্কৃতি দফতর জঙ্গলমহলকে একটা বাড়তি আয়ের পথ দেখাবে, তা কে জানত! রাজ্যে পালাবদলের পর এমনই উন্নয়নের ছবি ঝাড়গ্রামের জঙ্গল মহলের আনাচে কানাচে।
যেমন, বেলিয়াবেড়া থানার ডুলুং নদীর পাড়ে ছবির মতো ছোট গ্রাম ফুটিপাল। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ শ্রমজীবী। এই গ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ নিমাই কিস্কু, রাম মান্ডি, প্রশান্ত হেমব্রমরা দিনমজুরি করে সংসার চালান। ঘরের মেয়েরা সারাদিন গরু–বাছুর সামলান। কাজের শেষে নিজেদের সংস্কৃতির টানে সন্ধের সময় গ্রামের মধ্যে সকলে মিলিত হন। গ্রামের রঘুনাথ মেমোরিয়াল ক্লাব প্রাঙ্গণে ধামসা, মাদল, ঝুমকার তালে চলে নাচের তালিম। নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার এই চর্চা যে এমন ভাবে কাজে লাগবে, সেটা কল্পনাও করতে পারেননি বলে জানান ফুটিপালের এই বাসিন্দারা। এই গ্রামের রঘুনাথ মেমোরিয়াল ক্লাবের মহিলা ও পুরুষ মিলে প্রায় ২৯ জন লোকশিল্পী বর্তমান রাজ্য সরকারের কাছ থেকে এক হাজার টাকা করে সরকারি ভাতা পান। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের প্রচার ও সচেতনতা বৃদ্ধির অনুষ্ঠানে ডাক পড়ে এঁদের।
আবার ঝাড়গ্রামের লালগড় থানা এলাকা লাগোয়া সীমান্ত গ্রাম গঙ্গাধরপুর। ধেড়ুয়া হয়ে মেদিনীপুর যাওয়ার বাস রাস্তার পাশেই রয়েছে এই গ্রাম। গ্রামের উদ্যোগী পুরুষরাই তৈরি করেছেন ছৌ-নাচের দল। নাম গঙ্গাধরপুর সৎসঙ্গ ছৌ-নাচের দল। ১৯৮৫ সাল থেকে এই দলের সদস্যরা চর্চা চালিয়ে আসছেন। কিন্তু মাওবাদী অস্থিরতার কয়েকটা বছর পুরোপুরি ভাবে বন্ধ হয়ে যায় চর্চা। তবে নতুন সরকার আসার পর অনেকের উৎসাহে ফের শুরু হয় চর্চা। এই দলের সদস্য দিনেশ মাহাতো, তাপস মুদিরা জনমজুরির পাশাপাশি পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক পালা করেন। ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ পালার পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর কন্যাশ্রী এখন এঁদের অন্যতম জনপ্রিয় ছৌ-নাচের সামাজিক পালা। দীনেশ, তাপসরা রাজ্য সরকারের তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর থেকে মাসে এক হাজার টাকা করে সরকারি ভাতা পান বলে জানান।
শুধু ছৌ-ই নয়, সারা জঙ্গল মহল জুড়ে লোকসংস্কৃতির নানান আঙ্গিকের বহু দল রয়েছে। রয়েছেন ঝাড়গ্রামের জঙ্গল মহলের বৈচিত্র্যপূর্ণ লোকসংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শিল্পীরা। তাঁরা যে মা-মাটি-মানুষের সরকারের আমলে মাসে মাসে একটা ভাতা পাচ্ছেন, সে কথা একবাক্যে স্বীকার করেছেন সকলে। সরকারি পরিচয়পত্রও পেয়েছেন এইসব শিল্পীরা। তাঁরা বলছেন, এই উদ্যোগটাই মমতা সরকার আসার আগে ছিল না! গঙ্গাধরপুর উড়ানশোল ছৌ নৃত্য দলের প্রবীণ ওস্তাদ ৭০ বছরের দুর্গাপ্রসাদ মাহাতো। ছৌ ছাড়া কিছুই বোঝেন না। তিনি বলেন, ‘বর্তমান রাজ্য সরকার লোকপ্রসার প্রকল্পের মাধ্যমে এই এলাকার লোকসংস্কৃতির প্রসার ঘটানোর চেষ্টা যেমন চালিয়ে যাচ্ছে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও প্রচার করা হচ্ছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজও একসঙ্গে চলছে। আগে তো এসব দেখাই যেত না।’
রাজ্য সরকারের আদিবাসী লোকরঞ্জন শাখার প্রাক্তন শিল্পী, বিনপুরের দু’বারের প্রাক্তন বিধায়ক তথা ঝাড়খন্ড পার্টি (নরেন) নেত্রী চুনীবালা হাঁসদা বলেন, ‘লোকশিল্পীদের ভাতার প্রয়োজন আছে। সরকার ভাতা দিচ্ছে ঠিক আছে। কিন্তু শিল্পীদের শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হোক। মুমূর্ষু সরকারি লোকরঞ্জন শাখাকে বাঁচিয়ে তোলা হোক। সরকারি শিল্পী পদে নিয়োগ করা হোক। তৈরি হোক লোকশিল্পের সংগ্রহশালা। তা হলেই এই শিল্প ও শিল্পীরা বাঁচবেন। কিন্তু সরকারি প্রকল্পের কাজে লোকশিল্পীদের মাঠেঘাটে নামিয়ে প্রচারের কাজে ব্যবহারের বিরোধিতা করছি আমি।’ চুনীবালার মেয়ে তথা সাঁওতালি সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেত্রী বীরবাহা বলেন, ‘আমাদের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির পুনর্জীবন ঘটেছে। মানুষের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে। গ্রামে গ্রামে নিয়মিত চর্চা শুরু হয়েছে।’