তিনি আমেরিকায় জন্মালে অস্কার পেতেন। এ কথা বলেছিলেন স্বয়ং ভারতের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়। আর যাঁর সম্পর্কে এ কথা বলা, তিনি অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী। আজ তাঁর ১২০ তম জন্মদিন। ১৮৯৯ সালের ৩রা মার্চ কৃষ্ণনগরেরর গোয়ারীতে জন্মগ্রহণ করেন এই প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা। বাবা আশুতোষ চক্রবর্তী রেলে কাজ করতেন, ফলে ছেলেবেলা থেকেই তিনি অনেক ঘুরেছেন। পরে বাবার অকালমৃত্যুর পর অল্প বয়সেই তুলসী পড়াশোনার পাট চুকিয়ে জ্যাঠামশাই প্রসাদ চক্রবর্তীর কাছে কলকাতার জোড়াসাঁকোয় আশ্রয় পান।
মা নিস্তারিণী দেবীকে নিয়ে কলকাতায় এসে তার প্রথম লক্ষ্যই ছিল একটা ভাল চাকরী খোঁজা। ভাল গান গাইতে পারতেন, বিশেষ করে কীর্তনাঙ্গের গান। গিরিশ পার্কের পার্বতী ঘোষ লেনের ব্যায়ামাগারে নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীরচর্চাও করতেন। তুলসীর জ্যাঠামশাইয়ের অর্কেষ্ট্রা পার্টির গ্রুপ ছিল। কলকাতার বড়লোক রাড়িতে নানা অনুষ্ঠানে তাঁর দল নাটক করত। তুলসী চক্রবর্তীও সে দলে যোগ দিয়ে কীর্তন ও শ্যামা সঙ্গীত গাইতেন। পরে তাঁর জ্যাঠামশাই স্টার থিয়েটারে যোগ দিলে কলকাতার রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে চিৎপুরের এক মদের দোকানে বয়ের কাজ জোটালেন। কিন্তু জ্যাঠামশাই খবর পাওয়ায় তাঁকে কাজ ছাড়তে হল।
এরপর তিনি কাজ নেন এক ঘড়ি সারাইয়ের দোকানে। সেখানে বেশিদিন মন টিকল না তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে বর্মা গেলেন। যে জাহাজে পালালেন সেটিতে বোসেস সার্কাস পার্টিও চলেছিল। সেখানেই চাকরি নিলেন। মাঝে মধ্যে শোয়ের ফাঁকে জোকারও সাজতেন। এভাবেই তিনি হাস্য-কৌতুকের প্রতি ঝোঁকেন। একথা সত্য যে সারা জীবন হাস্য-কৌতুক করলেও তিনি কখনও ভাঁড়ামো করেননি। সার্কাসে থেকে তিনি কিছু খেলা যেমন শিখলেন তেমনি শিখলেন উর্দু ও হিন্দী বলতে। সার্কাসে তিনি ছয়মাস মতো ছিলেন।
এরপর জ্যাঠামশায় এক ছাপাখানায় কম্পোজিটরের কাজ জুটিয়ে দিলেন। সেখানে থিয়েটারের হ্যান্ডবিল ও পোস্টার ছাপা হত। তা দেখেই তুলসীর মনে প্রথম অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছে জাগে। জ্যাঠামশায়কে অনেক অনুরোধ করায় তিনি স্টার থিয়েটারে অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের সাহায্যে ঢোকালেন। সে সময় প্রেসে তার মাইনে ছিল ৩২টাকা। স্টারে এলেন ৮ টাকার মাইনেতে! তৎকালীন স্টার থিয়েটারের মালিক ছিলেন অপরেশ মুখোপাধ্যায়। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তুলসী চোখে পড়ে যান অপরেশবাবুর। সালটা ছিল ১৯১৬। এই অপরেশবাবুই তালিম দেন তুলসী চক্রবর্তীকে।
স্টার থিয়েটারে টপ্পা গান, পাখোয়াজ বাজানো সব শিখেছিলেন। ১৯২০ তে প্রথম স্টেজে অভিনয় করেন। নাটকের নাম ছিল ‘দুর্গেশনন্দিনী’। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত তিনি স্টারেই ছিলেন। পরে যোগ দেন, মনমোহন থিয়েটারে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪২টি নাটকে অভিনয় করেন। তুলসী চক্রবর্তীর সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন ১৯৩২ সালে, নিউ থিয়েটারের ‘পুনর্জন্ম’ সিনেমায়। পরিচালক ছিলেন সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। তাঁর শেষ সিনেমা মৃত্যুর আঠারো বছর পর মুক্তি পায় ১৯৭৯সালে ‘আমি রতন’। এরপরই নিজের অভিনয় ক্ষমতার গুণে বাংলা চলচ্চিত্রে নিজের আলাদা জায়গা তৈরি করে নেন তিনি।
১৯৩২ থেকে ১৯৬১ তিন দশক ধরে আমৃত্যু বাংলা চলচ্চিত্রকে একের পর এক রত্ন দিয়ে গেছেন তিনি। কখনও তিনি পথের পাঁচালী ছবির প্রসন্ন পন্ডিত, কখনও সাড়ে চুয়াত্তর-এর মেসমালিক রজনী বাবু। কখনও আবার পরশপাথর-এর পরেশ চন্দ্র দত্ত। তিনি না থাকলে হয়ত পরশপাথর করার কথা ভাবতেনই না সত্যজিৎ রায়। তবে এটা হয়ত অনেকেই জানে না যে জীবনে একফোঁটাও মেক আপ ব্যবহার করে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াননি তুলসী চক্রবর্তী। আবার ক্যামেরার আড়ালে তাঁর জীবন ছিল কঠিন দারিদ্রে জর্জরিত। যৎসামান্য নুন আনতে পান্তা ফুরনোর মতো দশা। এতটাই অভাব ছিল যে টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়া থেকে শিবপুরে বাড়ি পর্যন্ত হেঁটেই যেতেন। তবু ছাড়তে পারেননি অভিনয়। আর এখানেই যেন রিয়েল লাইফের দরিদ্র তুলসীকে হারিয়ে দিয়ে জিতে গিয়েছিলেন রিল লাইফের তুলসী। সত্যজিতের মতে যিনি, ভারতের মরিস শিভ্যালিয়র।