জানি আমার মত অসংখ্য ভারতবাসীর ভালবাসা আর শুভেচ্ছায় আপনি ইতিমধ্যেই অস্থির হয়ে গেছেন। আমি সেই দলেই এক সামান্য সংযোজন। দেশকে রক্ষার জন্য সাহস আর বীরত্বের পাশাপাশি শত্রুব্যুহের মধ্যেও আপনার ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষমতা আমাকে অবাক করেছে। এই দেখুন, আপনার প্রশংসা করতে গিয়ে আবেগে আমি আমার পরিচয় দিতেই ভুলে গিয়েছি। এই আমাদের একটা বড় দোষ, বড়ই আবেগপ্রবণ আমরা। যাই হোক আমি একজন সামান্য আলোকচিত্রী, প্রায় ৪০বছর পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার দুটি প্রধান দৈনিকে কাজ করেছি। প্রত্যক্ষ কোন অভিজ্ঞতা না থাকলেও যুদ্ধ, সৈনিক, সীমান্ত, বীরত্ব কোনকিছুই আমার অপরিচিত নয়। আপনার মধ্যে আমি একটা বিশেষ জিনিস দেখেছি, যা আমাকে মুগ্ধ করেছে তা হল, বুদ্ধি ও বীরত্বের সঙ্গে আপনি সৌজন্যকে একসঙ্গে মিলিয়েছেন। বিশেষ করে এই সৌজন্য ব্যাপারটাই দল-মত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষদের মধ্যে এখন কম।
বীর যোদ্ধা আমাদের দেশ কম দেখেনি। চিন-ভারত যুদ্ধ থেকে শুরু করে পাক-ভারত যুদ্ধ, বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় অসংখ্য বীর জওয়ান দেশ রক্ষার জন্য আত্মবলিদান করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়া এসে যাওয়ার পর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এখন মানুষ বাড়ি বসেই পেয়ে যান। এই আমলে সেনাদের কাজকর্ম আমরা আগের তুলনায় অনেক বেশি জানতে পারি। আমাদের ছেলেবেলায় এ সুযোগ ছিলনা যেমন, সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে আমরা ধরা পড়ার পর পাকিস্তানে আপনার লাঞ্ছনা প্রত্যক্ষ করলাম। কিন্তু আপনার ব্যাপারটা একটু বিশেষ হয়ে উঠেছে একারণেই যে দীর্ঘদিন জঙ্গি সন্ত্রাস সহ্য করার পর পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীদের পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য পাকিস্তানে জঙ্গি ঘাঁটিতে বিমান হানায় অংশ নিয়েই আপনি পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। ধরা পড়ার পরও আপনার মানসিক স্থৈর্য একটুও টাল খায়নি। পুলওয়ামায় পাকমদতপুষ্ট জঙ্গিদের হাতে ৪০জন সেনার নিহত হওয়ার প্রত্যুত্তর দিতেই জঙ্গি ঘাঁটিতে বায়ুসেনার এই অভিযানের পরিকল্পনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই দুঃখবহ এবং দেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে বিপজ্জনক ঘটনাটাকে নিয়ে শুরু হয়েছে শাসকদলের আত্মপ্রচারের রাজনীতি।
আমাকে অবাক করেছে সেনাবাহিনীর বীরত্ব নয়, দেশের মানুষের তাদের প্রতি নিঃশর্ত ভালবাসা আর বিশ্বাস নয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাতের যাবতীয় কৃতিত্ব বিজেপি দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দিতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রীও তার ৫৮ইঞ্চি বুকের ছাতি আরও চওড়া করে এমন বক্তৃতা জুড়ে দিয়েছেন যে, যেন তার জন্যই এই হামলাকে রুখে দেওয়া সম্ভব হল। শিক্ষা দেওয়া গেল পাকিস্তানকে। আপনাকে দেশে ফিরিয়ে আনাও নাকি মোদির কূটনৈতিক সাফল্য। আবার ভারতীয় সেনাদের হানায় নিহত জঙ্গিদের সংখ্যা নিয়ে সরকারি বক্তব্য অনেক বিভ্রান্তিও সৃষ্টি করেছে।
ধরা পড়ার পর পাক সেনারা আপনার সঙ্গে যা ব্যবহার করেছে এবং তাদের প্রতি আপনার আচরণ একদিকে যেমন ভারতের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে ঠিক তেমনি পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক মহলে সমস্যার মুখে ঠেলে দিয়েছে। জেনিভা কনভেনশনের নিয়ম অনুযায়ী তারা আপনাকে আটকে রাখতে পারতো না। পুলওয়ামায় জঙ্গি হানার পর আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে কোণঠাসা পাকিস্তান নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্যই আপনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে। এতে যেমন পাকিস্তানের কোন মহানুভবতা নেই ঠিক তেমনই প্রধানমন্ত্রীরও বিশেষ কোন একক কৃতিত্ব নেই।
প্রশ্ন হল এটা করা হচ্ছে কেন? কারণ একটাই তাহল, প্রধানমন্ত্রীর একটা দেশের রক্ষাকর্তা মার্কা ভাবমূর্তি তৈরি করে আগামী সাধারণ নির্বাচনে ফায়দা তোলা। বিজেপি ভাবছে প্রধানমন্ত্রীর এই ভাবমূর্তি তাদের ভোটে জিতিয়ে দেবে। বিদেশী জঙ্গিদের সন্ত্রাস ও আক্রমণ রোখার কাজে সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী দেশকে নেতৃত্ব দেন। দেশবাসী তাদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্পণ করেন তার ওপর। কিন্তু তার মানে এই নয় সেনাদের আত্মত্যাগ ও বীরত্ব এবং সাধারণ মানুষদের সমর্থন বাদ দিয়ে তাকেই দেশের একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসেবে তুলে ধরা হবে। এ এক অদ্ভুত রাজনীতি, গণতন্ত্রে এমন হয়না। কোন ব্যক্তি নয়, মানুষ এবং সেনারাই দেশের নিরাপত্তা রক্ষার সবচেয়ে বড় বর্ম। আমাদের ঘর থেকে আসা লক্ষ লক্ষ জওয়ানরাই জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে নীরবে দেশকে রক্ষা করে চলেছেন।
আমাদের বুঝতে হবে মোদি মানেই ভারত নয়, তিনি একজন মানুষের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি মাত্র। অথচ দলীয় প্রচারের মহিমায় গোটা ব্যাপারটা যেন হয়ে উঠেছে বিজেপির একক কৃতিত্বের এক প্রদর্শনী। যে কাজটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে করাটা স্বাভাবিক তিনি সেই কাজটাই করেছেন। অথচ মানুষ, সেনা সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু প্রধানমন্ত্রীকে এমনভাবে তুলে ধরা হচ্ছে যে, দেশে গণতন্ত্র কথাটার কোন মানে থাকছে না। কূটনীতি বলুন বা যুদ্ধক্ষেত্র সেখানে প্রধানমন্ত্রী বা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী ও সেনাপ্রধানদের একটা নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে। মোদি সেই ভূমিকাটাই পালন করছেন। যেমন ওআইসিতে আমাদের দেশের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ পাকিস্তান কেন এই সন্মেলন বয়কট করছে তা সুন্দরভাবে যুক্তি ও তথ্য সহকারে তুলে ধরেছেন। যুক্তি দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন আজ থেকে ৫০বছর আগে ভারত থাকলে আমরা থাকবো না এই অজুহাত দেখিয়েই পাকিস্তান ওআইসি বয়কট করেছিল। ভারতের সঙ্গে যুক্তিতে এঁটে উঠতে না পেরে সন্মেলন থেকে তাকে বাদ দেওয়ার জন্য এভাবেই চাপ সৃষ্টি করেছিল তারা। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি।
দেশকে রক্ষার জন্য দেশপ্রেম অবশ্যই থাকবে, এই দেশপ্রেমকে সঙ্গী করেই এগোবে গণতান্ত্রিক ভারত। পাকিস্তানের মত সেনানায়কদের অঙ্গুলিহেলনে চলা দেশগুলি আমাদের ওপর নানা ছুতোনাতায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করবে। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ভারতবিরোধী জিগির তুলে জঙ্গি সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাইবে তারা। শত্রুকে প্রতিহত করার জন্য সমবেত প্রচেষ্টাই দেশপ্রেম। এই দেশপ্রেম কোন নেতা, দল বা প্রধানমন্ত্রীর একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। যুদ্ধ হিংসা-রক্তপাত এড়িয়ে শিক্ষা-শিল্প-কৃষিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই দেশপ্রেম। যুদ্ধবাজদের দেশপ্রেমে রয়েছে শুধু ধ্বংস আর হানাহানি। সাধারণ মানুষের দেশপ্রেমে রয়েছে সৃষ্টি, বিকাশ ও সুরক্ষা।
শত্রুর আক্রমণ এড়াতে আতঙ্কমাখা বাঙ্কার নয়, দেশকে আমরা দেখতে চাই মানুষজনের কোলাহল মুখর ঘরবাড়ি, উজ্জ্বল চোখমুখের ছেলেমেয়েদের স্কুল, শিশুদের খুশিমাখা মাঠ এবং ক্ষেতে ও কারখানায় মানুষের শ্রমের মধ্যে। অভিনন্দন, আপনার মত মানুষরা তো এই শান্ত ও স্বচ্ছন্দ জনপদকে রক্ষা করার জন্যই জল-স্থল-অন্তরীক্ষে অতন্দ্র প্রহরায় থাকেন। দেশপ্রেম মানে যে অন্য দেশকে দখল করার মত কোন মারকুটে ব্যাপার নয়, এটা তো মারমুখী পাক সেনাদের সামনে আপনার স্পষ্ট মন্তব্য ও স্বাভাবিক সৌজন্য দেখেই শিখলাম। বুঝতে পারলাম আমিই সব করেছি মার্কা যে দেশপ্রেম এদেশে মোদিরা চালু করতে চাইছেন এরসঙ্গে তার তফাৎ আছে। প্রকৃত দেশপ্রেমে দেখনদারি ও কৃতিত্বের বিজ্ঞাপন নেই। আছে সংকল্পে অবিচল থেকে নীরবে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া। এও আমরা আপনাকে দেখে নতুন করে শিখলাম। বয়সে আপনি আমার চেয়ে অনেক ছোট হলেও আমার প্রণাম নেবেন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত আপনাদের গোটা পরিবার থেকেই আমার মত মানুষদের অনেক কিছু শেখার আছে। আপনাদের মত সাহসী পরিবারের জন্যই আমরা নিরাপদে থাকতে পারি।
উষ্ণ অভিনন্দন,
জয় হিন্দ, বন্দে মাতরম
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত