কথায় আছে, অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। কিন্তু অতি ‘দেশভক্তি’? এ নিয়ে কোথাও কোনও বলা না থাকলেও পুলওয়ামার জঙ্গী হামলার পর ঘটে যাওয়া একাধিক ঘটনা এদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তা কেবল বিদ্বেষ বা হিংসা ছড়িয়ে মার-দাঙ্গা করারই লক্ষণ। আর এতদিন এই দেশভক্তি সোশ্যাল মিডিয়াতে আটকে থাকলেও, পুলওয়ামা কাণ্ডের পরে তা বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে বিতর্ক এবং সমস্যা, দুটোই আরও বেড়েছে।
পাড়ার ভিতর বা বড়রাস্তার মোড়, শহরতলির গলিপথ থেকে খাস কলকাতার রাজপথ— সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে এই দেশভক্তদের। সময়ের কোনও ঠিক নেই। দুপুর হোক বিকেল হোক, কিংবা সন্ধে বা মাঝরাত, জাতীয় পতাকা হাতে বেরিয়ে পড়ছে এই দেশভক্তের দল। মুখে স্লোগান- ‘ভারতমাতা কি জয়’। সেইসঙ্গে রয়েছে গালিগালাজের ঝড়ও। সকলেই অশ্লীল ভাষায় দুষছে প্রতিবেশী দেশকে।
বিভিন্ন প্রান্তে এই দেশভক্তদের বাড়বাড়ন্ত দেখে সংশ্লিষ্ট সমাজবিদ এবং গবেষকেরা বলছেন, এক দিকে মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যুদ্ধ। প্রতিহিংসার মন্ত্র দিয়ে হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে অদৃশ্য মেশিনগান। অন্যদিকে, ন্যায়বিচার বদলে যাচ্ছে প্রতিহিংসায়। কখনও বাণিজ্যিক বা কখনও রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে এই স্নায়বিক এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দীর কথায়, ‘আড়াইশো বছর আগে স্যামুয়েল জনসন বলেছিলেন, দুবৃত্তদের শেষ ভরসা হল (উগ্র) দেশপ্রেম! এখন চারিদিকে যা পরিস্থিতি, তাতে ওই উক্তির বাস্তবতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আর এই দেশপ্রেমের আধুনিক রূপকার সোশ্যাল মিডিয়া।’
আশিসবাবুর ব্যাখ্যা, ‘সোশ্যাল মিডিয়া আর কিছুই নয়, মুনাফাখোর ট্রোলার। মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থে। তবে আমেরিকায় যেমন এখন বেশির ভাগ চ্যানেলের সংবাদকে আর সেখানকার মানুষ গুরুত্ব দেয় না, এখানেও তেমন এই সোশ্যাল মিডিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে এর আগ্রাসন কমবে।’ পাশাপাশি, পুলওয়ামার ঘটনায় ঘৃণা ছড়ানো প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘এখনও মানুষের মনের মধ্যে দেশভাগের ভূত ভর করে রয়েছে। পুরনো প্রজন্মের কাছে শোনা কাহিনিগুলি অদৃশ্য ভাবে অবচেতনে কাজ করে। সেটাকেই নানা ভাবে সুড়সুড়ি দেওয়া হয়।’
পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান ঋতু সেন চৌধুরীর মতে, ‘শান্তি এবং ন্যায়বিচারের তুলনায় দ্বেষ এবং প্রতিহিংসা বেশি বিক্রি হয়। ফলে এখন বহু ক্ষেত্রেই হিংসা ন্যায়বিচারের জায়গা নিচ্ছে। বিচারের জন্য চর্চা, নিজস্ব সময়, যুক্তি ও ধৈর্যের প্রয়োজন। কে আর অত সময় দেবে! বরং সহজ হল, আজ যারা শান্তির কথা বলছে, তাদের উপর গায়ের ঝাল মেটাও।’ তাঁর কথায়, ‘এটাই এখন প্রশ্ন যে, ‘আ ওয়েনেস ডে’ ছবির বিখ্যাত সংলাপ পাওয়ার অব আ কমন ম্যান আসলে ঠিক কী? তাকে তো এখন ফ্যাসিস্ট যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। শুধু পুলওয়ামা কাণ্ডই নয়, সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এই ফ্যাসিস্টধর্মী অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।’
ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের অধিকর্তা ভামিক ভলকান-এর তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রত্যেকটি দেশ তাদের কোনও একটি বিপর্যয়কে ‘বেছে নেয়’। ভলকান একে বলছেন ‘চোজেন ট্রমা’। সে দেশের প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই বিপর্যয়টির সঙ্গে নিজেদের জাতিগতভাবে একাত্ম করে রাখে। সেই দুঃখ বা ক্ষত তার অবচেতনে গড়ে দেয় প্রতিশোধচেতনাও।
ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানীদের একটি অংশ মনে করেন, ভারতে দেশভাগও সেই চোজেন ট্রমা যা উপন্যাস, গান, শ্রুতির মাধ্যমে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এত বছর পরেও সেই স্মৃতি বদলায়নি। বরং স্মৃতিবাহিত হয়ে মানুষের মস্তিষ্কের বাম গোলার্ধকে (যা যুক্তি নিয়ন্ত্রণ করে) অকেজো করে, জাগিয়ে তোলে মস্তিষ্কের ডান গোলার্ধকে (যা নিয়ন্ত্রণ করে আবেগ, প্রতিহিংসা, ভয়, ঘৃণা)। মুসলিমদের প্রতি বদলার মনস্তত্ত্বের এটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তাঁরা।
আবার সমাজতত্ত্বের শিক্ষক আন্দ্রে বেতেই মনে করেন, যাঁরা বীরত্ব দেখাতে গিয়ে হিংসা ছড়ান, তাঁরা যে সবটা ভেবে বা বুঝে করছেন, তেমনটা নয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, “একবার এক বন্ধু হঠাৎ ট্রাম থেকে নেমে আমার হাতে বইটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দাঁড়াও দু’ঘা দিয়ে আসি’। দেখি, রাস্তার এক পাশে কয়েক জন মিলে এক যুবককে পেটাচ্ছেন। আমার সেই বন্ধু জানতেনও না তাঁরা কেন মারছেন। আমি জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘সকলে যখন মারছেন, তখন নিশ্চয়ই পকেটমার হবে।’ তাই তিনিও মারতে চলে গেলেন।’’