“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি”
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা আন্দোলনের দি্নে এই অমর গানটি রচনা করেন ১৮ বছরের যুবক,পরবর্তীকালের খ্যাতনামা সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী।এই গানটির মাধ্যমে ফুটে উঠেছে বাংলা ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।আর প্রথমে আবদুল লতিফ ও পরে আলতাফ মাহমুদের জনপ্রিয় সুরে গানটি প্রতিটা বাঙালির,এপার-ওপার সবার,মনে গেঁথে গিয়েছে।এই গানটির মধ্যেই বাঙালি খুঁজে পেয়েছে একুশের সংগ্রাম, বাংলা ভাষার রক্ষার্থে জীবন-মরণ সংগ্রাম, বাঙালির লড়াইয়ের কাহিনীর মর্মকথা।এই গানটি আজও যখন শোনা হয় তখন আমাদের দু-চোখ অশ্রুতে ভরে ওঠে সেইসব বীর ভাষা শহীদদের কথা স্মরণ করে।সত্যিই তো “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” তা কি আমি ভুলতে পারি? কেউ কি ভুলতে পারে বীর ভাইদের যাঁরা তাদের জীবন তুচ্ছ করে বাংলা ভাষা রক্ষার্থে নিজেদের জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করেছেন। তাই আমরা এই একুশের মাসে এই প্রবন্ধে সশ্রদ্ধে স্মরণ করব সেইসব বীর শহীদ ‘ভাই’দেরকে।
১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্ট ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে জন্ম নেয় পাকিস্তান। পাকিস্তান দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। এক পূর্ব পাকিস্তান আর অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। পরাধীন ভারতের বঙ্গদেশের পূর্বাংশ,যার নাম ছিল পূর্ব বাংলা, তাই দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচয় লাভ করে।১৯৪৮ এমনকি ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগে থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদল জোর করে উর্দু ভাষাটি পাকিস্তানের সমগ্র মানুষের উপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিতে চাইছিল।তারা এটা বোঝেনি যে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলা।মুসলিম লীগের বিভিন্ন নেতা তা চৌধুরী খলীকুজ্জামান হন আর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহই হন-সবাই চাইতেন উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্থান দিয়ে বাঙালির উপরেও জোর করে উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দিতে তা সে শত অসহনীয় অত্যাচারের মাধ্যমেও।আপামর বাঙালি এই অন্যায় মেনে নেয়নি।বাংলার মানুষ মেনে নেবেন কেমন করে?তাঁরা যে বাংলা ভাষা অন্ত প্রাণ।পূর্ব বাংলা্র নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ মানুষ সকলেই চাইতেন মাতৃভাষা বাংলার উচ্চ মর্যাদা এবং বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে।তা সেই থেকে শুরু হল ভাষা আন্দোলনের লড়াই যা ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-এ প্রকৃত সংগঠিত রূপ নেয় পাঁচ জন কাজা তরুণ শহীদের রক্তে।বীর ভাষা শহীদদের জীবনী নিয়ে আলোচনা করার আগে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক অমর একুশের কাহিনী।
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার লড়াই যখন চলছে একাধিক নেতা যখন চলছে, একাধিক নেতা যখন জেলে সেই টালমাটাল অবস্থায় ২০শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে পাকিস্তান সরকার।সেই ধারা অনুযায়ী জনসভা,শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ করা হয়।এই ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্তে অবিচল থাকে পাক-সরকার।কিন্তু বাঙালিকে থামাবে কেমনে? বাঙালির আন্দোলন,বাংলার আন্দোলন কি থামতে পারে?পারে না।আর পারে না তা আঁচ করেই পরদিন অর্থাৎ ২১ শে ফেব্রুয়ারি সকাল ৭টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাইরে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী অবস্থান গ্রহণ করে। নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ৮টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর বর্তমান যা মেডিকেল কলেজের ভিতরে অবস্থিত, সেখানে জমায়েত করে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা।যেহেতু নির্ধারিত কর্মসূচি ছিল সেহেতু পুলিশ ঘটনাটি আঁচ করেই সকাল সাতটা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে চলে আসে।এরপর চত্বরের আমতলায় বেলা প্রায় ১১ টার সময় গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ছাত্রসভা আরম্ভ হয়। সেখানে উপস্থিত ছাত্রের বেশিরভাগ ১৪৪ ধারা ভঙ্গন করার সিদ্ধান্ত নেয়।সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্র্ররা ১০জন করে একেকটি দলে বিভক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে বেরোন।আর বেরোনো মাত্রই পুলিশ তাঁদের উপর হামলা চালায়।গোটা এলাকাটাই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় এবং সারা দুপুর ধরেই পুলিশের সাথে ছাত্রদের ধস্তাধস্তি চলে।বিকেল তিনটে ১০ মিনিটে পুলিশ দুই দফায় ২৭ রাউন্ড গুলি চালায় যাতে ২১ জন নিহত হন। কমপক্ষে শহীদ হন চারজন।এম.এ. দ্বিতীয় পর্বের ছাত্র আবদুল আবুল বরকত প্রথম শহীদ হন।এরপর যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁরা হলেন আবদুল জব্বার ও রফিকউদ্দিন।পরে শহীদ হয়েছেন আবদুস সালাম।এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদী আন্দোলন সংঘটিত হয়। সন্ধ্যা নাগাদ সমস্ত দোকানপাট স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঢাকা শহরে নেমে আসে শোকের ছায়া। রাজশাহী কলেজের নিউ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতের বেলা তৈরি করা হয় ভাষা শহীদদের প্রতি প্রথম শহীদ মিনার যা পরেরদিন পুলিশ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। আমরা যে শহীদ মিনারটি দেখি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের ভেতরে তা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ২৩ শে ফেব্রুয়ারি,১৯৫২ সালে গড়ে তোলেন।
আমরা এতক্ষণ সংক্ষেপে পরিচয় লাভ করলাম ২১শে ফেব্রুয়ারি,১৯৫২ তারিখের সংঘটিত আন্দোলনের সাথে। শহীদ মিনারকে সাক্ষী রেখে এবার বীর বাংলা ভাষা শহীদদের সাথে পরিচয় করে নেব।
সর্বপ্রথম যাঁর নাম আমাদের মাথায় আসে তিনি হলেন শহীদ আবুল বরকত।আবুল বরকত জন্মগ্রহণ করেন অখন্ড বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলা(বর্ত্মান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত)-র কান্দি মহকুমা ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে ১৯২৭ সালের ১৬ ই জুন।বহরমপুর কলেজ থেকে আই.এ.(ইন্টারমিডিয়েট অফ আর্টস)পাশ করে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন ১৯৪৮ সালে এবং ওই বছরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।১৯৫১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্মানিক স্নাতকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে চতুর্থস্থান লাভ করেছিলেন।২১শে ফেব্রুয়ারির দিন বরকত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে তাঁর এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন এবং সেখানেই পুলিশের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন।অত্যধিক রক্তক্ষরণে তিনি সেইদিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ভর্তি অবস্থায় রাত্রি আটটায় মৃত্যুবরণ করেন।তাঁর বয়স তখন পঁচিশও পার হয়নি এবং তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের ছাত্র ছিলেন।বহুকষ্টে তাঁর ক্ষতবিক্ষত দেহটি উদ্ধার করা হয় এবং আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়।
আবুল বরকতের পর স্মরণ করি শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ-কে যিনি আবুল বরকতের থেকে প্রায় মাস আটেকের বড়ো।তাঁর জন্ম ৩০শে অক্টবর,১৯২৬ সালে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানার পারিল গ্রামে।তাঁর পিতার নাম আবদুল লতিফ আর মাতার নাম রাফিজা খাতুন। তিনি ছিলেন তাঁর পিতা-মাতার প্রথম সন্তান।তাঁর পিতা প্রেসের ব্যবসায় নিযুক্ত ছিলেন।রফিকউদ্দিন মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন।আন্দোলনের সময় তিনি সেই কলেজেরই বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।রফিকউদ্দিন একুশে ফেব্রুয়াঋর দিনে শহীদ না হলে তিনি বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হতেন ফেব্রুয়ারি মাসেই।বিবাহের সমস্ত কিছু ঠিক হয়ে গিয়েছিল।পাত্রীর নাম পানুবিবি।একুশে ফেব্রুয়ারির দিন শোনা যায় তিন ছাত্রের নিহত হবার খবর।শহীদ রফিকের ভগ্নিপতি মোবারক আলী খান জানান যে রফিকউদ্দিনের মাথায় গুলি লেগেছে।শোনা যায় যে, গুলির আঘাত এতোই জোরে ছিল যে তাঁর মগজ বেরিয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়ে গিয়েছিল।এতটাই মর্মান্তিক ভাবে মৃত্যু হয় এই শহীদের।ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ১৭ নম্বর রুমের পূর্বদিকে তাঁর লাশ পড়ে ছিল যা ছয় সাত জন ধরাধরি করে এনাটমি হলের পেছনের বারান্দায় এনে রাখেন।তাঁদের মাঝে ডাঃ মশাররফুর রহমান খান রফিকের গুলিতে ছিটকে পড়া মগজ হাতে করে নিয়ে যান।
এরপর আসি শহীদ আবদুল জব্বার-এর সম্পর্কে।ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁওতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৩ আগস্ট ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে।আর্থিক কষ্ট তাঁদের পরিবারের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল।আর সেই আর্থিক কষ্টের দরুন পঞ্চম শ্রেণীর বেশি লেখাপড়া শিখতে পারেননি তিনি।তাঁর এক বিচিত্র স্বভাব ছিল মাঝে মাঝে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া।একদিন তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে তাঁর জন্মভূমি ছেড়ে নারায়নগঞ্জে চলে যান।সেখানে তাঁর সাথে পরিচয় হয় এক ইংরেজ সাহেবের। তাঁর সাথেই তিনি চলে যান তৎকালীন বর্মায়,বর্তমানে যাকে মায়ানমার বলে আমরা চিনি। বর্মা বা ব্রহ্মদেশে তিনি প্রায় ১২ বছর কাটান।তারপর দেশে ফিরে এসে আমেনা খাতুন নামের এক মেয়েকে বিবাহ করেন।পাকিস্তানের প্রতি আবদুল জব্বারের চরম বিতৃষ্ণা,ঘৃণা কাজ করত যা প্রকাশ পেত পাকিস্তানকে ফাকিস্তান বলে উপহাস করার মারফতে।ভাষা আন্দোলনের দিনে তিনি তাঁর ক্যান্সারে আক্রান্ত শাশুড়িকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসেন।ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ভাষা আন্দোলন তখন চলছিল এবং সেই প্রাঙ্গণে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কয়েক হাজার বাঙালির সমাবেশে তিনি অংশীদার হয়ে যান।একুশের দিনের সেই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে যাঁরা শহীদ বরণ করেন আব্দুল জব্বারের নাম তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়।
এবার শহীদ আবদুস সালাম-এর জীবন নিয়ে আলোকপাত করা যাক।আব্দুস সালাম জন্মগ্রহণ করেন ২৭শে নভেম্বর ১৯২৫ সালে ফেনী জেলার দাগনভূঞা বা দাগনভূঁইয়া উপজেলার লক্ষনপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ ফাজিল মিয়া।আবদুস সালাম দাগনভূঁইয়া কামাল আতাতুর্ক হাই স্কুলে নবম শ্রেণি অবদি পড়াশোনা করতে পেরেছিলেন।অর্থাভাবের দরুন তাঁর আর পড়াশোনা করা হয়নি।বরং চাকরির সন্ধান করতে হয় এবং সেই সন্ধান করতে করতে তিনি ঢাকায় আসেন এবং সরকারি শিল্প অধিদপ্তরের চাকরি লাভ করেন।জানা যায় যে,ঢাকায় তিনি ৩৬/ বি নীলক্ষেত ব্যারাকে বসবাস করতেন।একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করাতে ছাত্রেরা সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ আন্দোলন করে সেই আন্দোলনে আবদুস সালাম অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই বিক্ষোভ পুলিশ গুলি চালালে তিনি গুরুতর আহত হন।তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও বাঁচানো যায়নি।দেড় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ৭ই এপ্রিল ১৯৫২ সালে সেই হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।আজিমপুর গোরস্থানে যেখানে আবুল বরকত ও অন্যান্য শহীদদের দাফন করা হয়েছিল সেখানে তাঁকে দাফন করা হয়।
শহীদ শফিউর রহমান।এই ভাষা শহীদ জন্মগ্রহণ করেন আখন্ড বাংলার ২৪ পরগণা জেলার কোন্নগর(বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় অবস্থিত)গ্রামে ২৪ শে জানুয়ারি ১৯১৮ সালে।আলোচিত ভাষা শহীদদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ইনি। কলকাতা গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজ থেকে আই.কম.(ইন্টারমিডিয়েট অফ কমার্স)পাশ করেন।এরপর, ২৪ পরগণা সিভিল সাপ্লাই অফিসে কেরানীর কাজ করেন।১৯৪৫ সালের ২৮শে মে তিনি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন কলকাতা নিবাসী তমিজউদ্দিন আহমেদের কন্যা আকিলা খাতুনের সঙ্গে। দেশভাগের পর তাঁর পিতা মাহবুর রহমানের সাথে ঢাকায় চলে আসেন।শফিউর রহমান পড়াশোনার পাশাপাশি ঢাকা হাইকোর্টে হিসাবরক্ষণ শাখায় কেরানীর পদে চাকরি করতেন।২২শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখে সকাল ১০ টার দিকে তিনি তাঁর রঘুনাথ দাস লেনের বাসা থেকে সাইকেলে চড়ে রওনা হন অফিসের দিকে। অফিসে যাওয়ার পথে নওয়াবপুর রোডে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন মিছিলের উপর পূর্বদিনের মতো পুলিশ গুলিবর্ষণ করাতে শফিউর রহমান গুলিবিদ্ধ হন।তাঁকে তৎক্ষণাৎ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করালেও তিনি আর বাঁচতে পারলেন না।একুশের পরের দিন তিনি শহীদ হন। মারা যাওয়ার পর তাঁর লাশ পুলিশ আত্মীয়দের কাছে হস্তান্তর করেনি।তারপর কর্তৃপক্ষের নির্দেশে অতিকষ্টে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে তা আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়। সেই আজিমপুর গোরস্থানে যেখানে পূর্বদিনে দাফন করা হয়েছিল শহীদ আবুল বরকত,রফিকউদ্দিন আহমদ ও আবদুস সালামকে। এখানে বলা বাহুল্য যে শহীদ আবুল বরকতের কবরের পাশেই কবর দেওয়া হয় শহীদ শফিউর রহমান কে।
২২শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-র আরেক শহীদ হলেন আবদুল আউয়াল। পেশায় তিনি ছিলেন রিকশাচালক। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ হাশিম।তিনি ঢাকার ১৯, হাফিজুল্লাহ রোড ঠিকানায় বসবাস করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তখন ছাত্র বিক্ষোভ চলছিল তখন আউয়ালও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।বর্তমান ঢাকা রেল হাসপাতাল কর্মচারী সংলগ্ন এলাকায় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর মোটর গাড়ির নীচে চাপা পড়ে তিনি মারা যান বলে জানা যায়।তখন তাঁর বয়স ছিল আনুমানিক ২৬। এখানে উল্লেখ্য যে, শহীদ আবদুল আউয়ালের শিশুকন্যা বশিরনকে নিয়ে ২২ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ সালে সন্ধ্যায় শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।২২শে ফেব্রুয়ারির,১৯৫২ তারিখে আরও এক অজ্ঞাত বালকের কার্জন হল এলাকায় মোটর গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় বলে জানা যায়।
নিষ্ঠুর,অমানবিক পাকিস্তান পুলিশের বন্ধুকে তাণ্ডবের থেকে নিষ্কৃতি পায়নি আট-নয় বছরের বালকও।শহীদ মো.অহিউল্লাহ ছিল শিশু শ্রমিক, পেশায় রাজমিস্ত্রি।তার পিতার নাম হাবিবুর রহমান।১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার নবাবপুর রোডে খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে মাথায় গুলি লেগে সে গুলিবিদ্ধ হয়।নিষ্ঠুর পাকিস্তান পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে অতি দ্রুততার সাথে তার লাশ সরিয়ে নিয়ে গায়েব করে দেয়।
এরকমভাবে বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে অসংখ্য ব্যক্তি শহীদ হয়েছিলেন।যাঁদের মধ্যে অনেকেই আমাদের কাছে অজ্ঞাত।তাঁদের প্রত্যেকের আত্মত্যাগ ও রক্তের কালিতে রচিত হয়ে আছে বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। বাহান্নর এই ভাষা আন্দোলন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দ্বার উন্মোচন করে দেয় যার ফলে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় বাঙালির এক স্বাধীন রাষ্ট্র-‘বাংলাদেশ’।তার সাথে বিশ্বজুড়ে মর্যাদা লাভ করে আমাদের মাতৃভাষা-‘বাংলা ভাষা’।১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় যা একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের মুকুটে অন্যতম সোনার পালক হিসেবে যুক্ত হয়। নিজের মাতৃভাষার জন্য বাঙালির এই আত্মত্যাগ বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। তাই,বাঙালিই পারে বলতেঃ-
“মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা! ”