“এ রাত্তিরে দাঁড়িয়ে আছি এই টুকুনি আশায়/
লাশগুলো কাল কইবে কথা, আমার মাতৃভাষায়।”
আজ সারারাত লাশ গুলো আমার সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলবে। জব্বর, তাজুদ্দিন অহমেদ পায়চারি করবে সারারাত রক্ত মাখা পাঞ্জাবি গায়ে, মেঝেতে আঁকিবুঁকি কাটা হবে অ আ ই ঈ। আমার বাংলা হরফে।
আমার প্রথম চুমুর শব্দ, আমার মন খারাপ এ বিড়বিড়, আমার মায়ের রান্নাঘর এ গুনগুনিয়ে গান বেঁচে থাকবে অক্ষর মালায়। বাংলার অশ্মিতাতে।
আমরা বাঙালিরাই বোধহয় বিশ্বের সবচেয়ে আত্মবিস্মৃত জাতি। এমন এক ন্যাতানো বেগুনভাজা যার সমস্ত সম্ভাবনা ছিল মুচমুচে হওয়ার কিন্তু হাতে থাকলো রুমাল আর জেলুসিল এ আভিমান।
ঢেকুর এর শব্দ শুনে এক সময় বাঙালি চেনা যেত। বুড়ো আঙুল চেটে, শেষ পাতে দই আর জোয়ান এর আড়ক খাওয়া ঢেকুর। কান পাতলে শোনা যেত মন্ত্রচ্চারণ এর মত এক সাথে অ এ আম, খ এ খেজুর।
এখন চেনা যায় ফেসবুক লাইভে “হাই ফ্রেন্ডস কেমন আছো তোমরা?” শুনলে। “নমস্কার বন্ধুরা” আজ বড্ড সেকেলে। তাই ফ্রেন্ডস বলতেই হয়। পাউট করে বলতে হয় হেলোওওওওওও!
কেন বাঙালির নিজের ভাষার প্রতি অহংকার থাকবে না? গোটা বিশ্বে কোথাও নিজের ভাষায় কথা বলার দাবিতে কেউ হয়তো একটা গোটা যুদ্ধ লড়ে না। লড়বে না। বাঙালিরা লড়েছে।
মাথায় রাখবেন, যে দেশত্ববোধের বড়াই হয় গো- বলয় থেকে, সেই দেশের “বন্দে মাতরম” ও “জন গন মন” কিন্তু হিন্দিতে লেখা হয় নি। ওটা জনো গনো মনো হবে। জ্যানা গনা ম্যানা আধিনায়াকা নয়।
অনেকে তো আবার বাংলা বলে কিছু আছে সেটাই সারা বছর ভুলে থাকে। মাঝেমধ্যে মা এর আঁচল মনে পরলে ওহ! ক্যালকাটায় মেয়োনিজ দিয়ে মোচার চপ আর দুর্গা পুজোয় ডিজাইনার ধুতি। ব্যাস! বাকি সময় বাচ্চা কে যুদ্ধকাকালিন ভাবে বাংলা থেকে দূরে রাখার কাজ চলে। আর কি শেখানো হয় হাট্টিমাটিমটিম? আমরা কিরকম বকচ্ছপ হয়ে যাচ্ছি দিন দিন।
যখন একজন বিদেশি তার নিজের বাচনভঙ্গিতে, উচ্চারণ এ ইংরাজি তে কথা বলে, আমরা কল সেন্টার এ বিশেষ ভাবে তা রপ্ত করি, কিন্তু যখন আমরাই আমাদের উচ্চারণ এ ইংরাজি বলি, তা হয়ে যায় ‘বাবুমশাই accent”।
ইংরেজরা চলিয়া গেলেও হায়, হ্যাংওভার রাখিয়া গেছে। তাই হয়তো কোলকাতাতেই ময়লা উর্দি পরা কোন রেস্তোরা শ্রমিক ইংলিশ এ কথা বলা খদ্দেরকে আদেখলা খাতির করে মোক্যাম্বোতে আর বাংলায় কথা বল্লেই, রুক্ষ “বলুন কি লাগবে”-র মাঝামাঝি কোথাও রাখে।
নিজের ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগে, ভবিষ্যৎ এ আমার সন্তান অ আ ক খ কে প্রাচীন কোন গুহা ভাস্কর্য ভেবে নেওয়ার আগে আসুন সামান্য কিছু করি। বাংলার জন্য। বাংলা ভাষার জন্য।
প্রেমে ব্যথা পেয়ে কোন মেয়ের মুখে এসিড ছোঁড়ার থেকে অনেক ভালো বাঙালির হাফসোল খাওয়া বানান ভুল আনাড়ি বাংলা কবিতা লেখা।
জয় বাংলা।
©—–ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ