পুলওয়ামায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের সন্ত্রাসের ঘটনাকে ব্যবহার করে দেশে ঘৃণার আবহাওয়া তৈরি করতে নেমে পড়েছে বিজেপির নেতৃত্বে একশ্রেণীর তথাকথিত দেশপ্রেমী। এদের দেশও নেই, প্রেমও নেই। শুধু আছে মতান্ধতা, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। ভারতীয় সেনাদের আত্মদানকে ব্যবহার করে দেশজুড়ে একটা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ তৈরি করতে চাইছে এরা। সময় সময় মতান্ধতার কাছে প্রাজ্ঞতা ও সাংবিধানিক দায়িত্ব হেরে যায়, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মেঘালয়ের রাজ্যপাল তথাগত রায়। তিনি খোলাখুলিভাবে কাশ্মীরিদের বয়কটের ডাক দিয়েছেন। একটা জনপদের সব মানুষকে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বা প্রশ্রয়দাতা হিসেবে দেগে দিয়ে তিনি বস্তুত তাদের পাক সন্ত্রাসবাদীদের কোলেই ঠেলে দিচ্ছেন। এই বিচিত্র রাজনীতি কাদের হাত শক্ত করবে তা তার মত একজন প্রবীণ মানুষ একবারও ভেবে দেখলেন না!
দেশপ্রেমের নামে শুরু হয়ে গেছে পাড়ায় পাড়ায় ঘৃণা ও সন্ত্রাসের এক প্রতিযোগিতা। বিজেপি জানে যারা এই অপকর্মটি করছেন তাদের কাউকেই কৃতকর্মের দায়িত্ব বহন করতে হবেনা। এই উস্কানিমূলক কাজে বিপন্ন হবে আমাদের দেশেরই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। রামদেবের মত ধর্মগুরু থেকে শুরু করে পাড়ার কালুদা কেউই পিছিয়ে নেই। পাকিস্তানকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার নামে শুরু হয়ে গেছে গোটা ব্যাপারটার সঙ্গে কোনরকম সম্পর্ক না থাকার মানুষদের ওপর তথাকথিত দেশপ্রেমীদের হামলা, কটূক্তি ও হুমকি। পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা তো ঠিক এই জিনিসটাই চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল ধর্মান্ধতার বিষ ছড়িয়ে আমাদের দেশের বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনটা আলগা করে দিতে, দেশের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে লড়াই লাগিয়ে দিতে। এটাই তো বিজেপির রাজনীতি।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুরু থেকেই বিজেপির এই তথাকথিত দেশপ্রেমের রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। প্রশাসনের নজরদারিও কড়া তাই এখনও বড় কোন হাঙ্গামা ঘটেনি। কিন্তু আমার একটা জিনিস অবাক লাগে দিদির চারপাশে বিভিন্ন সময়ে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি জগতের বিভিন্ন মানুষরা ঘোরাফেরা করেন, যাদের দিদি নানাভাবে সহায়তা করেন তারা কী করছেন? এরাও তো কোন না কোন পাড়ায় থাকেন, তাহলে এই তথাকথিত দেশপ্রেমীদের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদে সরব হচ্ছেন না কেন? মনে রাখবেন ঘৃণা ও বিদ্বেষের আগুনের আঁচ কিন্তু আপনাদের গায়েও লাগবে।
একই কথা খাটে বিভিন্ন দল থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়া নেতাদের সম্পর্কেও। আপনারা তো নিজেদের এলাকায় জনপ্রিয় ও পরিচিত ব্যক্তিত্ব বলে দাবি করেন, তাহলে এই ঘটনা ঠেকাতে আপনারাও সক্রিয় ভুমিকা নিচ্ছেন না কেন? সব কাজই কি দিদি বলার পর করতে হবে? পুলওয়ামার ঘটনার পর প্রমাণিত হয়েছে প্রত্যক্ষ সন্ত্রাস যেকাজ করতে পারেনি, পরবর্তী পর্বে তথাকথিত দেশপ্রেমীদের তাণ্ডব কিন্তু দেশের ঐক্যভাঙা এবং মানুষে মানুষের ভেদাভেদ সৃষ্টির কাজে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। এই দেশপ্রেমীদের আমাদের যে কোন মূল্যে প্রতিহত করতে হবে। দেশপ্রেমের নামে এই বিদ্বেষের রাজনীতির বিরুদ্ধে সাংবাদিক ও প্রেসক্লাবেরও একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে। সাংবাদিকরাও তো সবাই কোন না কোন পাড়াতেই থাকেন। তথাকথিত দেশপ্রেমীদের বিরুদ্ধে আঞ্চলিকভাবেও তো সরব হতে পারেন তারা।
পাক রাষ্ট্রপ্রধান ইমরান খান এখনও এই ঘটনার নিন্দা করেননি, বরং তিনি হুমকি দিয়েছেন ভারত এই ঘটনার জবাব দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা নিতে চাইলে পাকিস্তান তার পাল্টা জবাব দিতে প্রস্তুত। কিন্তু এই হুঙ্কারের সামনে পাক মহিলারা ভারতীয় সেনাদের ওপর পাক জঙ্গি হামলার নিন্দা করেছেন। অথচ আমাদের তথাকথিত দেশপ্রেমীরা কিন্তু এই নৃশংস ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও জনমত গড়ে তোলার রাস্তায় না হেঁটে ঘৃণা ও হাঙ্গামা পাকানোর রাজনীতির মাধ্যমে পাক সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে প্রকৃত লড়াইটাকে কঠিন করে তুলছেন। বিজেপি মদতপুষ্ট কিছু দেশভক্ত হনুমান সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে পাড়ায় পাড়ায় এমন একটা জিগির তুলছে, কাশ্মীরি এবং মুসলমান মানেই সন্ত্রাসবাদী এবং দেশের শত্রু। এই উস্কানিতে বিভিন্ন জায়গায় তাদের ওপর হামলা বাড়ছে, সাধারণ মানুষের একাংশের মনে তাদের বিরুদ্ধে তৈরি হচ্ছে ঘৃণা। সন্ত্রাস ও আক্রমণের পরিণতিতে এদের অনেকেই এলাকা ছেড়ে পালাচ্ছেন। পাক জঙ্গিদের হামলা এদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজটা সহজ করে দিয়েছে।
এগুলো সাধারণ মানুষের কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্য নয়, পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ফেসবুকে দেখলাম একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল লিখছেন, কাশ্মীর এম্পোরিয়াম এবং কাশ্মীরি শালওয়ালাদের কাছ থেকে কোন জিনিস কিনবেন না এরা নাকি সবাই সন্ত্রাসবাদী! তথাকথিত এসব দেশপ্রেমীর মন্তব্যের প্রতিবাদ করলেই শহরের নানা জায়গায় প্রতিবাদীর বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে একশ্রেণীর মানুষ। এদেরকে এলাকার মানুষ কোনদিন দেখেননি। মুখে একটি বিশেষ সম্প্রদায়বিরোধী গালিগালাজ এবং হাতে লাঠিসোটা হাতে এই মানুষরা তাদের কাউকে পাড়ার থেকে তাড়াচ্ছে, কারও ধোপা, নাপিত বন্ধ করার হুমকি দিচ্ছে। পাড়া ছাড়িয়ে এরা ছড়িয়ে পড়ছে বাসে, ট্রেনে, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। যে কোন সুস্থ, স্বাভাবিক ধারনারই এরা বিরোধী। এমনকি সন্দেহজনক চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করে ভিক্ষুক ও মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের বিরুদ্ধে হামলা হচ্ছে।
দেশপ্রেমের এই ধরণ বাংলা এর আগে কোনদিন দেখেনি। শঙ্খ ঘোষ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, আবুল বাশারের মত কবি, সাহিত্যিকরা এই বিপজ্জনক প্রবণতার নিন্দা করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একটা অংশের মধ্যে এই আবেদন কাজ করলেও কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকাসহ বিভিন্ন জেলার মিশ্র সম্প্রদায়ের মানুষ অধ্যূষিত এলাকার নিম্নবর্গের মানুষ এতে কতটা সাড়া দেবেন তা বলা কঠিন। কলকাতার রাজাবাগান, তপসিয়া, তিলজলার মত এলাকায় এইসব দেশপ্রেমিকদের উস্কানিতে উত্তেজনা বাড়ছে। একটা কথা পরিষ্কারভাবে বলে নেওয়া ভালো এই মুহূর্তে দেশের সব মানুষকে এক হয়ে এবং পাক হামলাবাজদের সবক শেখানোর উদ্যোগকে সমর্থন জানাতে হবে। একইসঙ্গে এটাও সত্যি যে প্রতিবাদের নামে ভারতে বসবাসকারী কাশ্মীরি এবং সংখ্যালঘু মানুষদের ওপর কোনরকম হামলা চালানো যাবেনা। ছড়ানো যাবেনা কোন বিদ্বেষমূলক কুৎসা ও কুরুচিকর মন্তব্য। এতে আমাদের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শই বিপন্ন হবে।
পাক হামলার পরবর্তী ঘটনাবলীর থেকে প্রমাণিত হয়েছে ভারত এখনও এব্যাপারে অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। আমেরিকা, ফ্রান্স, ইজরায়েল একে একে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণের ঘটনায় পাকিস্তানের নিন্দা করেছে। হামলার সফল প্রত্যুত্তর দিতে শুরু করেছে ভারতীয় সেনারা। অতিউৎসাহী নির্বোধ এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজদের কাজকর্ম এই অবস্থাটাকে ঘেঁটে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ঠ। দেশপ্রেমের নামে ঘৃণা ও সন্ত্রাসের রাজনীতি আমাদের অসুবিধাজনক অবস্থানে ঠেলে দেবে, ভাঙবে দেশের ঐক্য। কয়েকজন ধর্মান্ধের কাজের দায় চাপবে আমাদের ওপর। সমস্ত আবেগ ও কুৎসাকে বাদ দিয়ে আমাদের ঠাণ্ডা মাথায় এদের জানাতে হবে দাঙ্গাবাজ ও ধর্মান্ধদের কোন দেশও নেই, হৃদয়ে প্রেমও নেই।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )