কথায় আছে, সবার উপর মানুষ সত্য। হোক না শত্রু, কিন্তু মরণাপন্ন একটা প্রাণকে বাঁচানোর চেষ্টা করাটা মনুষ্যত্বের লক্ষণ। তেমনটাই করেছেন তিন সিআরপি-র জওয়ান অভিনব কুমার, রাজকিশোর প্রধান, সন্দীপ কুমার। ঘণ্টাখানেক আগে থেমে গিয়েছে গুলির লড়াই। অতিরিক্ত কম্যান্ডান্ট মহারানা বীরেনপ্রতাপ সিংহের ইশারা পেয়ে ইচ্ছাবেরার ঘন জঙ্গলের ঝোপঝাড় ও গাছের আড়াল থেকে সন্তর্পণে একে একে বেরিয়ে এলেন সিআরপি-র জওয়ানেরা। কিছক্ষন আগেও উল্টো দিক থেকে ক্রমাগত গুলি চালিয়ে গিয়েছে মাওবাদীদের দল। সিআরপি পাল্টা গুলি চালানো শুরু করায় কিছু ক্ষণ আগে থেকে মাওবাদীদের গুলির শব্দ বন্ধ হয়েছে। বীরেনপ্রতাপের অভিজ্ঞতা বলে দিল, এলাকা ছেড়েছে প্রতিপক্ষ।
বীরেনপ্রতাপের হাতের ইশারায় যখন এক-এক করে বেরিয়ে আসছেন জওয়ানরা তখনই দেখা গেল শরীরটা। কালো পোশাক পরা, জঙ্গলের ঝোপঝাড়ের মাঝে পড়ে রয়েছে। সতর্ক জওয়ানেরা বন্দুক উঁচিয়ে এগিয়ে গেলেন শরীরটার দিকে। বাঁ পায়ের উরু ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে গুলি। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন বছর কুড়ির মাওবাদী নেত্রী নানকি সুরেন। তাঁর কাছে বন্দুক নেই, হয়তো নিয়ে গিয়েছেন তাঁর সহযোদ্ধারা। পড়ে ছিল কিছু তাজা গুলি।
ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল পা দিয়ে। প্রাথমিক চিকিৎসার কিছু পাঠ নেওয়া ছিল কনস্টেবল বিচিত্রকুমার সোয়েন ও বীরবাহাদুর যাদবের। গাছের পাতার ‘ওষধি’ লাগিয়ে কাপড় দিয়ে ক্ষতস্থান বন্ধ করে দেন তাঁরা। খবর যায় চক্রধরপুরে সিআরপি-র ৬০ নম্বর ব্যাটেলিয়ানের কম্যান্ডান্ট প্রেমচন্দ্র গুপ্তের কাছে।
রবিবার ফোনে প্রেমচন্দ্র বলেন, ‘‘নানকিকে আহত অবস্থায় আমাদের সোনুয়ার ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়েছিল। এখান থেকে এএসআই পঙ্কজ শর্মাকে অ্যাম্বুল্যান্স দিয়ে পাঠাই। পঙ্কজও প্রাথমিক চিকিৎসায় পটু। পঙ্কজ ও অন্যরা মহিলাকে ক্যাম্প থেকে তুলে ওখানকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যায়। কিন্তু চিকিৎসকেরা দেখে জানান, এতটা রক্তক্ষরণ হয়েছে যে, চিকিৎসার জন্য চাইবাসা নিয়ে যেতে হবে।’’
নানকিকে ওই অ্যাম্বুল্যান্সে করেই চাইবাসা নিয়ে যাওয়া হয়। সদর হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলেন, অবিলম্বে রক্ত দিতে হবে।
প্রেমচন্দ্র বলেন, ‘‘আমাদের দিকেই গুলি ছুড়ছিল ওরা। আমাদের কেউ মারাও যেতে পারত। কিন্তু, তা হয়নি। শত্রুপক্ষের কাউকে যদি আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি, তাকে বাঁচিয়ে তোলাটাও আমাদের দায়বদ্ধতা। তিনিও আমার দেশের বাসিন্দা। আর এ তো সবে জীবন শুরু করা একটি বাচ্চা মেয়ে।’’
বাহিনীর কাজকর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল অনেকেই জানাচ্ছেন, প্রতিপক্ষকে জীবিত অবস্থায় ধরা এবং আহত অবস্থায় পেলে সুস্থ করে তোলাই বাহিনীর কাজ। জীবিত অবস্থায় ধরা না গেলে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোনও তথ্য পাওয়ার সুযোগই থাকে না। সে দিক থেকেও নানকিকে সুস্থ করে তুলে জওয়ানেরা তাঁদের উচিত কর্তব্যই করেছেন।