রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই যে কাজটি তিনি নিরন্তর করে চলেছেন, গতকাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি এবং তাবড় তাবড় শিল্পপতিদের সামনে তারই খতিয়ান তুলে ধরলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উন্নয়ন ও লগ্নি— এই দুইয়ের মেলবন্ধনেই যে আজ দেশের মধ্যে এগিয়ে বাংলা, বৃহস্পতিবার বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের প্রথম দিনেই তা পরিস্কার করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু শুধু বাংলারই নয়, তিনি সর্বভারতীয় নেত্রীও বটে। তাই উন্নয়ন চান সারা দেশে, প্রতিটি রাজ্যেই। তবে মোদী জমানায় তা কতটা সম্ভব? কেন্দ্রের জনবিমুখ কাজকর্মে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ফলে খুব সঙ্গত কারণেই দেশ-বিদেশের বাণিজ্য প্রতিনিধি, অতিথিদের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে এই প্রশ্নটিকেই আরও উস্কে দিলেন মমতা। মোদীর নাম উচ্চারণ না করেও তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তুললেন তিনি।
বৃহস্পতিবার নিউ টাউনের কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত বাণিজ্য সম্মেলনের প্রথম দিনে তখন উপস্থিত অন্তত ৪ হাজার দেশি–বিদেশি বাণিজ্য প্রতিনিধি। তাঁদের সামনে মমতা দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকেও সামনে নিয়ে এলেন। বললেন, ‘আপনারা জানেন, নির্বাচন আসছে। অনেক শিল্পপতি নানা সমস্যায় দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। জানি, এ কথাটা বলার জায়গা এটা নয়। তবু শিল্পবন্ধুদের বলছি, দেশে ফিরে আসুন। কেন্দ্রে সরকার বদল হলেই আমরা নতুন শিল্পনীতি ঘোষণা করব। যাতে দেশের শিল্পায়ন আরও জোরদার হয়।’
মমতার মতে, ‘সারা দেশ যেমন এগোচ্ছে, তার সঙ্গে দ্রুত উন্নতির পথে বাংলাও। আমি চাই বাংলার পাশাপাশি পাঞ্জাব, বিহার, উড়িষ্যা, রাজস্থান— সব রাজ্যের উন্নতি হোক।’ রবীন্দ্রনাথের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘লক্ষ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গি সুদূরপ্রসারী হলে, তবেই জয় করা যায়। ইতিবাচক ভাবতে হবে। সবাইকে নিয়ে এগোতে হবে।’ রাজ্যের সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেশকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে বরাবরই বদ্ধপরিকর মমতা। তাঁর গতকালের ভাষণেও বার বার সে কথাই ফুটে ওঠে।
বৃহস্পতিবার মঞ্চে ছিলেন অর্থমন্ত্রী ড. অমিত মিত্রর সঙ্গে ৩৬টি দেশের বাণিজ্য প্রতিনিধিরা। যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কোরিয়া, জাপান, ফ্রান্স, চীনের মতো অর্থনৈতিক উন্নতিতে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলি থেকে শিল্পপতি, রাষ্ট্রদূত, বণিকসভার কর্তারা রয়েছেন। এছাড়াও রাজ্যের মুখ্য সচিব মলয় দে, স্বরাষ্ট্র সচিব অত্রি ভট্টাচার্য–সহ আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, বন্দনা যাদব প্রমুখ উপস্থিত রয়েছেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই অতিথিদের উত্তরীয় পরিয়ে সম্মানিত করেন মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, শশী পাঁজা ও বিধায়ক মহুয়া মৈত্র।
মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ভাষণের শুরুতেই আগত সকলকে স্বাগত জানান। এরপরই বাম আমলের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘৩৪ বছর অপশাসন দেখেছে এই রাজ্যের মানুষ। কোনও উন্নতি হয়নি। ৭৫ লক্ষ শ্রমদিবস নষ্ট হয়েছিল ওই সময়ে। কিন্তু আমরা ক্ষমতায় আসার পর নষ্ট শ্রমদিবস শূন্যে নামিয়ে এনেছি। আমাদের রাজ্যের ছেলেমেয়েদের মেধা রয়েছে। দক্ষতা আছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দিই আমরা। তথ্যপ্রযুক্তি থেকে চা শিল্প, ছোট ও মাঝারি শিল্পের জন্য সুস্পষ্ট নীতি রয়েছে আমাদের।’
পরিসংখ্যান তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রী জানান, ‘গ্রামীণ উন্নয়নে গুরুত্ব দিয়েছে রাজ্য সরকার। গরিব মানুষের খাদ্য থেকে বাসস্থান সুনিশ্চিত করেছে। রাস্তা, পরিকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। রাজ্যের গড় অভ্যন্তরীণ উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে বহু গুণ। রাজস্ব আসছে অতিরিক্ত হারে। সারা দেশে ২ কোটি মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে আমরা ৪০ শতাংশ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করেছি।’ বাংলায় লগ্নির আহ্বান জানিয়ে আরও বলেন, ‘এখন আমাদের লক্ষ্যই বাণিজ্যের প্রসার। বাংলা হল ঐক্য ও বৈচিত্র্যের পীঠস্থান। সম্প্রীতির এত ভাল পরিবেশ অন্য কোথাও নেই। সব ভাষাভাষীর মানুষ এখানে বাস করেন। এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। পূর্ব ভারত ও পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির গেটওয়ে হল বাংলা।’
মুখ্যমন্ত্রী মনে করিয়ে দিয়েছেন, শিল্প স্থাপনে যে সব সুযোগ–সুবিধা দেওয়া দরকার, তারও বন্দোবস্ত রয়েছে এই রাজ্যে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, সড়ক পরিবহণ, উন্নত পরিকাঠামো থাকায় শিল্পস্থাপনে কোনও অসুবিধা হবে না। বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘ভুটান, বাংলাদেশ, নেপাল আমাদের প্রতিবেশী। তেমনই ব্যাঙ্কক, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে মাত্র ৩ ঘণ্টা লাগে। আরব দেশগুলির সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করা যায়।’ তাঁর দাবি, এইসব কারণেই শিল্পবাণিজ্যের প্রসারের সহায়ক এই রাজ্য।
অন্যদিকে, রাজ্যের উন্নয়ন প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলতে গিয়ে তিনি জানান, মহিলাদের ক্ষমতায়নে রাজ্য এগিয়ে রয়েছে। এখানে ২৮টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে। ১১ থেকে বেড়ে ৪২টি মাল্টি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। গরিব মানুষকে ২ টাকায় চাল দেওয়া হচ্ছে। বিনামূল্যে চিকিৎসা।’ এরপরই তাঁর গলায় শোনা গেল আত্মপ্রত্যয়ের সুর, ‘গত ৭ বছরে বিরাট পরিবর্তন এসেছে আমাদের রাজ্যে।’