দু’হাতে দশদিক সামলাতে সিদ্ধহস্ত তিনি। একদিকে রাজনীতিও করেন। আবার পাশাপাশি চালিয়ে যান শিল্পকলার চর্চাও। সমস্তটাই তার হাতের মুঠোয়। তিনি আর কেউ নন আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। যদিও লেখালিখি, গান, বাদ্যযন্ত্র বাজানো সমস্তটাই তার নেশা। গল্প-উপন্যাস-কবিতা ছাড়াও নানা বিষয়ে তিনি বই লেখেন। বাংলার বিরোধী দলের নেত্রী থাকাকালীন সময় থেকেই তাঁর লেখালিখির শুরু। বিরোধী নেত্রী থাকা কালীন তাঁর লেখা “উপলব্ধি” বই টি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
২০১১–তে ক্ষমতায় আসার পরেও লেখা থামাননি তিনি। রাজ্য রাজনীতি, মুখ্যমন্ত্রী পদ সামলে তার লেখার দিকে সময় দেওয়া কম হলেও তা মনের আড়াল কখনো হয়নি। এখনো প্রতি বইমেলায় তাঁর নতুন বই প্রকাশিত হয়। স্টলে তাঁর বই কেনার জন্য ভিড় ক্রমশ বাড়ে। এবারের বইমেলায় মোট ৭টি বই লিখেছেন মমতা। তাঁর ‘বিপন্ন ভারত’ নামের বইটিতে তিনি লিখেছেন, ২০১৪ সালে কেন্দ্রে বর্তমান সরকার আসার পর থেকেই ভারত বদলে গেছে। বদলের যে স্বপ্ন কেন্দ্র দেখিয়েছিলেন সেই বদল আদতে আলোর দিকে নয়। ভারতের ইতিহাস–ঐতিহ্য–পরম্পরাকে মুছে দিতে চাইছে বিজেপি।
মমতা লিখেছেন, ‘ভারতবর্ষ: ঐক্য ও সমন্বয়ের পুণ্যভূমি, ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের ঐতিহ্যগত ভিত্তি, ধর্মের নামে মানুষ খুন: রক্তাক্ত ভারতের মানচিত্র’। বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে এই বইটিতে। লেখা হয়েছে, স্বয়ংশাসিত কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি বিজেপির হাতিয়ার। বিজেপির জমানায় ভারত জুড়ে একাধিপত্য স্থাপন হচ্ছে দেখা যাচ্ছে ফ্যাসিবাদের ছায়া। এছাড়াও বহু কবিতা লিখেছেন তিনি, বিশেষত বাচ্চাদের জন্য। এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে ৪৩ টি কবিতা নিয়ে ‘আমি’ নামে একটি কবিতার বই। তার সব কবিতার মধ্যেই বিশেষ বক্তব্য রয়েছে। ‘বিদ্বেষ’ কবিতায় মমতা লিখছেন, ‘এত বিদ্বেষ কোথা থেকে এল / শীতঘুম থেকে বিদায় নিয়ে / এত অন্ধকার কুৎসিত রাতে ধৃত শব্দ রূপে এগিয়ে এল / এক পিশাচী আলো’। পুরোটাই বাস্তব এবং সত্য।
বইমেলায় প্রকাশিত ছোটদের বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘ছোটরা আমার খুব প্রিয়। শিশুদের আমি নিজের মতো করে ভালবাসি। তারাই আমাদের ভবিষ্যৎ, তারাই দেশের সম্পদ, তারাই বাংলা মায়ের যত মত, তত পথের আলোকবর্তিকা। ওদের কিছু কথা আমার মনকে দোলা দিয়েছে’। সেই থেকেই নতুন বইটির নাম হয়েছে ‘শিশুদোলা’। ২৪টি ছড়া আছে বইটিতে। এবং বইটির ভূমিকার শেষ লাইনে লেখা— ‘এগুলো শিশুরা পড়লে আমি খুব খুশি হব।’
এবার প্রকাশিত আরও একটি নতুন বই ‘আলোকবর্তিকা’। যার মুখবন্ধে লেখা হয়েছে, সংগ্রামী জীবনের মাধুকরী দর্শনীয় মূল্যবোধকে তিনি জাগিয়ে তুলেছেন ‘আলোকবর্তিকা’ নামক সংগ্রহে। লিখেছেন, ‘জটিল জীবনে নানা ঘাত–প্রতিঘাত, সঙ্ঘাত, কুটিলতাকে কাটিয়ে নিরবচ্ছিন্ন আনন্দে পথযাত্রী হওয়ার মূলধন হিসেবে এই বইটি জাতি–ধর্ম নির্বিশেষে হয়ে উঠুক মানুষের সঙ্গী’। তিনি আরো লিখেছেন, ‘মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া অনুচিত। মিথ্যা তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। সত্য সততার বিরাজমান হয়’। পাশাপাশিই লিখেছেন, ‘শরীরের যত্ন নিলে শরীর ভাল থাকে। যেমন ঘর পরিষ্কার রাখলে ঘর ভাল থাকে। নেতা সবাইকে নিয়েই এগিয়ে যায়। সাহসী হও, কিছু আশা কোরো না। এই পৃথিবীটা শান্তির জায়গা। যুদ্ধ বা ছায়াযুদ্ধর জায়গা নয়। আগুন লাগানো খুব সহজ। কিন্তু নেভানো খুব মুশকিল। বিশ্বাসের জায়গায় যদি অবিশ্বাস জন্ম নেয়, তবে বিশ্বাস আর কখনওই ফিরে আসে না।’
জীবন দর্শন বোঝানোর জন্য বলেছেন— ‘নিজেকে তৈরি করো, সুস্থ জীবন গড়ো। পথ সংগ্রামের ঠিকানা। উন্নত চরিত্র = সভ্যতার সা–রে–গা–মা–পা’। এর আগে মমতার লেখা ৪টি শায়েরির বই ‘রোশনি’, ‘তমন্না’, ‘খুশবু’ ও ‘সবেরা’ প্রকাশিত হয়েছে। এবার প্রকাশিত হল ‘ইনসাফ’। এতে স্থান পেয়েছে কিছু উর্দু শায়েরি। তার কয়েকটি লাইন — ‘বারিশ হো / তো হোনে দো / তুফান আয়ে / তো আনে দো / লেকিন কিসিকি / জান না জায়ে’।
তার লেখা সহজ সাধ্য, জটিলতা মুক্ত, সকলের বোধোগম্য। তিনি যেমন সাধারন মানুষের প্রতিনিধি তেমন ই তিনি লেখেন সাধারণ মানুষের জন্যই। লেখক মমতার এটাই আসল গুণ। তিনি যেমন সাদা ক্যানভাস রঙে মুড়ে দিতে জানেন, তেমনই শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে আঁকেন কবিতা। বড়ই সহজ-সরল ভাবে।