এই তো কিছু বছর আগের কথা। ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটা, রামপুরহাট স্টেশন থেকে সাইকেল রিকশায় চেপে রাঙামাটির পথ ধরে কুসুম্বা গ্রামে মামাবাড়িতে আসত। কিন্তু সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ আর ছোট্টটি নেই। সেই মেয়েটা এখন এতটাই ‘বড়’ হয়ে গেছে যে গোটা দেশের কাছেই সে আজ ‘দিদি’। সকলেই তাঁকে দিদি বলেই ডাকে। তবে এত বড় হওয়ার পরও ‘দিদি’ কিন্তু ভোলেননি সেই লাল মাটির পথ, সেই সাইকেল রিকশায় চেপে মামাবাড়ি যাওয়ার স্মৃতি। তাই পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো রামপুরহাটের প্রশাসনিক সভা সেরেই মামার বাড়ি কুসুম্বা গ্রামে চলে এলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
গ্রামে মুখ্যমন্ত্রী আসছেন। তাঁর আমলেই মাটির রাস্তা আজ পাকা হয়েছে। সঙ্গে হয়েছে ঢালাও উন্নয়নও। বুধবার সকাল থেকেই তাই গোটা গ্রাম সেই পিচরাস্তার ধারে এসে জড়ো হয়েছিল। মমতার প্রতীক্ষায় মামাবাড়ির মতোই তর সইছিল না আরেকটা বাড়িতেও। বাড়ির মালিক মন্টু দাস। মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাড়ির পরিচারক তিনি। তাঁর ছেলে কৃশানু দাসের বউভাতের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত মমতা।
বিকেল তিনটের সময় পিচরাস্তা ধরে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় কুসুম্বা গ্রামে ক্ষেপা কালী মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াতেই, তাঁর নামে কেউ জয়ধ্বনি দিলেন তো কেউ উলুধ্বনি। কেউ কেউ আবার শঙ্খও বাজালেন। করজোড়ে সেই অভ্যর্থনার জবাব দিয়ে সোজা মন্দিরে ঢুকলেন মমতা। বেরিয়ে নস্টালজিক মুখ্যমন্ত্রী। কয়েক পা দূরে টিনের চালার মাটির বাড়িটা মামা অনিল মুখোপাধ্যায়ের। হাঁটতে হাঁটতেই ছোটবেলার স্মৃতিচারণা। ‘ছোটবেলায় কালীপুজোর সময় ফি বছর মায়ের সঙ্গে নিয়ম করে আসতাম। মন্দিরে ধূমধাম করে পুজো হতো। ভোগ, আরও কত কী! খুব আনন্দ করতাম’—এক নিঃশ্বাসে বলেই চলছিলেন অগ্নিকন্যা।
মাটির বাড়ির গেটে ভাগ্নিকে স্বাগত জানালেন অনিলবাবু। প্রথমেই মামার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন মমতা। তাঁকে বললেন, ‘শরীরের প্রতি যত্ন নিও।’ মামাও ভাগনিকে বলেন, ‘রোগা হয়ে গেছ। ঠিক সময়ে খাওয়াদাওয়া কোরো। ঘুমও দরকার।’ মমতা বললেন, ‘আমি ঠিক আছি।’ বাইরে জনতার গর্জনে তখন কানপাতা দায়। মোবাইলে ছবি তোলার হিড়িক। বাড়িতে ঢুকে মাটির সিঁড়ি বেয়ে সোজা দোতলার সেই ঘরে, যেখানে মা গায়ত্রীদেবীর সঙ্গে এসে থাকতেন ছোট্ট মমতা। কিছুক্ষণ আগে রামপুরহাটের জনসভায় ‘ফায়ার ব্র্যান্ড লেডি’ হয়ে যিনি মোদি-শাহ জুটিকে ‘হুঁশিয়ার’ করে এসেছেন, কুসুম্বা গ্রামে মাটির বাড়ির সেই ঘরে তখন হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন ছোট বেলার স্মৃতিকে। এ এক অন্য মমতা।
এরপর দোতলা থেকে নেমে বাড়ির বৈঠকখানার চৌকিতে বসলেন মুখ্যমন্ত্রী। সঙ্গী মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন, অনুব্রত মণ্ডল। তাঁকে ঘিরে আত্মীয়স্বজনের ভিড়। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ বাড়িয়ে দিচ্ছেন অটোগ্রাফের খাতা, কেউ আবার সেলফি তোলার চেষ্টায়। এরমধ্যেই চায়ের পেয়ালা হাতে ফের স্মৃতির অতলে মমতা। বললেন- ‘এই যেখানে বসে আছি, এটা ছিল মামার স্টেশনারি দোকান। কী না বিক্রি হতো সেখানে। দুপুরে দোকান পাহারায় রেখে মামা যখন স্নানে যেতেন, আমি আর আমার এক মাসি, ছায়া মাসি, মিলে লজেন্স, বিস্কুট আরও কত কী লোপাট করে দিতাম! সন্দেহ হওয়ায় একবার মামা স্নানে না গিয়ে ফিরে এসে হাতেনাতে ধরে ফেলেন মাসিকে। আমি তো ছুটে পালিয়ে গিয়েছিলাম’- সলজ্জ হাসিতে দাপুটে মমতা তখন যেন সেই ফ্রক পরা কিশোরী।
ঘরে ঢুকে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে বসে কৃষিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় পকেট হাতড়ে বের করলেন একটা জমির পরচা। বললেন- ‘দেখুন, এটা আপনার পরিবারের রামপুরহাটের শিবতলাপাড়ার জমির কাগজ।’ পরচা হাতে নিয়ে খুশির ঝিলিক মমতার চোখেমুখে। ‘এতে তো ঠাকুর্দা পূর্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাবা আর জ্যাঠামশাইয়ের নামও লেখা আছে দেখছি।’ কাগজটায় হাত বোলালেন। এবার মোবাইল বের করে কয়েকটা ছবিও তুলে রাখলেন। অনুব্রত জানালেন, ‘দিদি, ওই জমিতে আটআনা অংশ তোমার বাবার’। এবার মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ- ‘ওই জমিটা মন্দিরের জন্য দান করে দাও’।
মামাবাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা হেঁটে এরপর মুখ্যমন্ত্রী এলেন মন্টু দাসের বাড়িতে। যে কারণেই তাঁর কুসুম্বা আসা। সেখানে তিনি ছিলেন মিনিট দুয়েক। মাথায় হাত দিয়ে নব বর-বধূকে আশীর্বাদ করেই তিনি বেরিয়ে যান সার্কিট হাউসের দিকে। বিয়েবাড়ি তখন লোকারণ্য। মুখ্যমন্ত্রীর উপহার হাতে নিয়ে বর-বধূ কৃশানু ও সঙ্ঘমিত্রা বললেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী যে আসবেন ভাবিনি। আমাদের বিয়ে স্মরণীয় হয়ে রইল। শুভেচ্ছা জানালেন আমাদের। আশীর্বাদও করলেন। আমরা রাতে তাঁর পছন্দের খাবার পাঠিয়ে দেব।’ জানা গেছে, রান্নার পদে ছিল মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দের মেনু সাদা ভাত, ডাল, বেগুনি, এঁচোড় চিংড়ি, মাংস, মাছ, মিষ্টি, দই, পাঁপড়।