১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাস। এক বাঙালি ভদ্রলোক একটু ইতস্তত হয়ে রাস্তায় লোকজনকে একটু থামতে বলছেন। দাঁড়ানো মাত্র কিছু একটা দিচ্ছেন। সময় ব্যয় করছেন না একেবারেই। ভদ্রলোকের হাতে একটি কাগজের ঠোঙা। স্বদেশি যুগের এই ঠোঙায় লুকিয়ে থাকতে পারত নিশ্চিতভাবেই বহু গোপন ছক, বোমার মশলা, রিভলভার, ছোট্ট চিঠি, পরবর্তী বৈঠকের স্থানকাল। কিন্তু তাঁর কাছে এহেন কিছুই ছিল না। কিন্তু বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর সেই মানুষটির ঠোঙাতে ছিল স্রেফ চপ। আজ্ঞে হ্যাঁ! চপ। তবে ব্রিটিশদের ভয়ে লোক ডেকে হইহই করে খাওয়াতে পারছেন না সেই ভদ্রলোক। কারণ তার চপ বিলির উপলক্ষ্য ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন। আসলে তারিখটা ছিল ২৩ জানুয়ারি। আর সেই মানুষটির নাম খেঁদু সাউ।
জন্মদিনে কেক কাটাই এখন রীতি। তবে পুরনো বাঙালি রেওয়াজ মেনে চললে পিঠে-পায়েস আবশ্যক। তাহলে চপ কেন? কারণ চপ বিক্রিই ছিল তাঁর জীবিকা। ১৯১৮ সালে খেঁদু সাউ কলকাতায় আসেন। বিহার থেকে প্রথমে হাওড়ায়, তারপর ‘রূপবাণী’ সিনেমা হলের সামনে তাঁর ছোট্ট চপের দোকান। আলুর চপ, পিঁয়াজি, ফুলুরি, আরও নানা আইটেম। নিজের হাতেই চপ ভাজতেন তিনি। তেলেভাজার এই জাদুবিদ্যায় আর দ্রব্যগুণে দোকানের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল কলকাতার কোণায় কোণায়। খেঁদু সাউ তখন রোজই তাঁর তেলেভাজা ও চায়ের কেটলি নিয়ে মানিকতলা ও কাশীপুর যাওয়া শুরু করেন। বিপ্লবীদের গোপন ডেরা থেকে আসত তাঁর অর্ডার।
সেখানে পৌঁছে খেঁদু সাউ পেতে দিতেন একটি খবরের কাগজ। তারপর চপ, পিঁয়াজি, ফুলুরি বের করে দিতেন একে একে। সঙ্গে থাকত মুড়ির পাহাড়। গোল হয়ে বসা বিপ্লবীদের মুখে তখন শহরের প্রান্ত প্রান্ত কীভাবে ইংরেজবিমুক্ত করে তোলা যায়– সেই স্বপ্নের ধারাভাষ্যই চলত রোজ। যার ফলে একজন সাধারণ মানুষ হয়েও তাঁর চোখ চকচক করে উঠত। যে শরীর স্বাধীনতার জন্য পুলিশের গুলি খেতে সদাপ্রস্তুত, যে শরীর মৃত্যুকে ডরায় না, সেই শরীরকে পুষ্ট করছে তাঁরই তেলেভাজা। তাঁদের চিন্তাকে উসকে দিচ্ছে তাঁরই হাতনির্মিত চা। এ কথাই বারংবার ভাবাত তাঁকে।
এমন চলতে চলতেই খেঁদু সাউও জড়িয়ে পড়লেন এই আন্দোলনে। তাঁকে বিপ্লবীরা তেলেভাজা খাওয়ার ছলেই বলে যেত গোপন খবর, ঠিক রাত্রি ক’টায়, কখন কার সঙ্গে দেখা করতে হবে। তিনি গোপন ডেরায় গিয়ে বলে আসতেন সেই খবর। এই রকমই একটি ডেরায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল নেতাজির। তখনও ‘নেতাজি’ হয়ে ওঠেননি তিনি। কিন্তু তরুণ সুভাষকে মনে রেখেছিলেন খেঁদু। এরপর যখন অনেক পরে তিনি দেখেছেন সেই সুভাষই নেতাজি হয়ে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে ব্রিটিশ সরকারের মনে, যাঁকে তিনি তেলেভাজা খাওয়াতে পেরেছেন, তখন থেকেই নেতাজির জন্মদিনে সেই ’৪২ সাল থেকেই চপ বিলি করে আসতে শুরু করলেন তিনি।
১৯৪২ সালে হাতিবাগানে জাপানি বোমা পড়েছিল। খেঁদু সাউয়ের দোকানের পাশের গলিতেও বোমা থেকে বেরনো লোহার টুকরো এসে পড়ে। কলকাতার অনেকেই তখন পালাচ্ছেন প্রাণভয়ে, নিজের বসতবাটি ছেড়ে। পালাননি খেঁদু সাউ। কারণ মৃত্যুভয়ে ভীত হতে তিনি শেখেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ’৪৮ সালের জন্মদিনে এই তেলেভাজা বিলি আর চোরাগোপ্তা রইল না। দোকানের বাইরে বোর্ড ও নেতাজির ছবি লাগিয়ে চলল লোকজন খাওয়ানো। লাইন পড়তে লাগল বিশাল। বড়দের চারটে ও ছোটদের দুটো। দোকানের নাম লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ অ্যান্ড সন্স। লোকে চেনে ‘নেতাজির চপের দোকান’ বলেই।
২০১৯ সালে এসেও ঐতিহাসিক রীতিটির কোনও নড়চড় হয়নি। খেঁদু সাউয়ের পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ থেকে বর্তমানে নাতি কেষ্টকুমার সাউ (গুপ্ত), প্রপৌত্র সুধাংশু সাউ (গুপ্ত) বাঁচিয়ে রেখেছেন এই রেওয়াজ। আজও দোকানের বোর্ডে লেখা রয়েছে ‘নেতাজির চরণে ভরসা’। সেই ভরসা খেঁদু সাউ থেকে রক্তবাহিত হয়ে সুধাংশু সাউ পর্যন্ত এসেছে। শতবর্ষ পেরিয়ে এসেছে এই দোকান। তেলেভাজার স্বাদবদল ঘটেনি। এই ২০১৯ সালেও তেলেভাজা ভাজা হবে মোট তিন জায়গায়। দেওয়া হবে প্যাকেটে করে। আগের মতোই এইদিন কোনওরকম বিক্রিবাটা চলবে না এই দোকানে। চলবে না টাকাপয়সার লেনদেন।
আলু, ফুলকপির চপ, বেগুনি, ফুলুরি থেকে পেঁয়াজি- আজ সব ফ্রি। ছোটদের জন্য বরাদ্দ দুটো করে চপ। আর পরিবারের জন্য চারটে। খাওয়ার পর একটা পয়সাও দিতে হবে না কাউকে। খাতায় কলমে কোনও হিসেব না থাকলেও অন্তত হাজার দশেক মানুষ নেতাজির জন্মদিনে বিনে পয়সায় চপ খায় ১৫৮ বিধান সরণীর এই দোকানে। এভাবেই আজও নেতাজির স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলছে এই ঐতিহাসিক দোকান। একইসঙ্গে খেঁদু সাউয়েরও।