রাত প্রায় সাড়ে দশটা, হোটেলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক সাধারণ ছোটখাটো চেহারার মহিলা। ঘনঘন ঘড়ি দেখছেন, কিছুক্ষণ পরপরই হোটেলের লোকজন তার কাছে এসে বলছেন, ম্যাডাম আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন। কিন্তু তিনি তা মানতে নারাজ। বললেন, আমার অতিথিরা এখনও আসেননি, আমাকে এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। এটাই সৌজন্য, এটাই ভদ্রতা। অবশেষে রাত সাড়ে দশটার পর সেই অতিথিরা এসে পৌঁছলেন। তারা হলেন অন্ধ্র ও কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু ও কুমারস্বামী। স্থান, তাজ বেঙ্গল হোটেলের গেট, কাল, ১৮/১/১৯, পাত্র, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমন নয় যে সেসময় তাজ বেঙ্গলের গেটে ছিল সংবাদমাধ্যমের ভিড় কিংবা চারপাশে দাঁড়ানো জনতার প্রবল উচ্ছ্বাস। প্রবল শীতে পাতলা একটা চাদর গায়ে অপেক্ষারত মুখ্যমন্ত্রীকে কেউ লক্ষ্যই করছিল না। কাজেই তার বিরুদ্ধে দেখনদারির কোন অভিযোগও আনা যাবেনা। এই হলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিরাভরণ আন্তরিকতা, সৌজন্য, চেষ্টা, কোন একটা কিছু শুরু করলে লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে তা সফলভাবে শেষ করাই বাংলার তৃণমূল নেত্রীর বৈশিষ্ট্য। এই চারিত্রিক গুণই ১৯তারিখের ব্রিগেডের মহাসমাবেশে সাফল্য এনে দিয়েছে।
কাজের সূত্রে দিদির সঙ্গে অনেকটা সময় থাকতে হয় বলেই জানি দিনভোর তার ওপর দিয়ে কী ধকল গেছে এবং কী আশ্চর্য দক্ষতায় তিনি তা সামলেছেন! রাজ্যের বাইরে থেকে আসা প্রায় সব নেতৃবৃন্দকে এভাবেই হোটেলের গেটে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। সাড়ে নটার সময় বাড়ি ফেরার একটু পরেই কাউকে কিছু না জানিয়ে আবার বেরিয়ে পরে দুই নেতাকে স্বাগত জানাতে চলে এসেছেন তাজ বেঙ্গলের গেটে। কারণ, ফ্লাইট লেট করায় দুজনের আসতে দেরি হচ্ছে। ছোটখাটো ডিটেলের দিকে তার সবসময় তীক্ষ্ণ নজর। একটা পা ফেলার আগেই তিনি ঠিক করে নেন পরবর্তী পদক্ষেপগুলি কী হতে পারে? বুঝতে পারেন তার সেই পদক্ষেপগুলির প্রতিক্রিয়াও। এসব বুঝতে তাকে যে বিরাট ভাবতে হয় এমনও নয়। এই গুণগুলিই তাকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। ব্রিগেডের মহাসমাবেশও তার ব্যতিক্রম নয়।
ছোট ছোট চেষ্টা, ছোট ছোট সাফল্য, জীবন যাদের একেবারে ছেঁটে ফেলে দিয়েছে সেইসব ছোট ছোট মানুষদের ভালোবাসা ও বিশ্বাসকে সঙ্গী করে তিনি আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছেন। মহাসমাবেশ নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা কথাবার্তা হচ্ছে। অতসব বিশ্লেষণের ক্ষমতা আমার মত সামান্য আলোকচিত্রীর নেই। তবে দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে বহু প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় ও রাজ্যমন্ত্রীদের সংস্পর্শলাভের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এমন আন্তরিকতা, জেদ, নিষ্ঠা এবং লড়াকু মনোভাব আমি আর কারোর মধ্যে দেখিনি। ব্রিগেডের মহাসমাবেশের প্রস্তুতি পর্বে আমি বারবার তার অসংখ্য নমুনা দেখেছি। কে কোথা থেকে কীভাবে আসবেন, কোথায় থাকবেন, কী খাবেন, ফিরবেন কীভাবে সব ব্যাপারে খুঁটিয়ে দেখার পর তিনি তাতে সন্মতি দিয়েছেন। এতটা তার করার দরকারও ছিলনা, কারণ দল এখন অনেক সংগঠিত। তবুও বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের প্রধানের মতই নিশ্চিত না হয়ে তিনি কোন ব্যাপারেই হ্যাঁ করেন না।
মঞ্চে ব্রিগেডে আসা সব নেতাই নিজে কিংবা তার পিএসওদের দিয়ে আমায় দিদির সঙ্গে তাদের ছবি দিতে বলছিলেন। শত্রুঘ্ন সিনহা, কুমারস্বামী, হার্দিক, জিগনেশ, স্ট্যালিন, তেজস্বী সবাই মহাসমাবেশের এই মুহূর্তটিকে ধরে রাখতে চাইছিলেন।� দিদি বরাবরই আমাকে তুই তোকারি করেন, মঞ্চে তাকে এই অনুরোধের কথা জানাতেই তিনি বললেন, হ্যাঁ, সবাইকে দিয়ে দে। এই সর্বভারতীয় নেতারা দিদির সঙ্গে তাদের একটা ছবি চাইছেন, কেউ তাকে দিদি বলছেন, কেউ বলছেন বহেনজি। আবার অনেক নেতাই আমাদের দিদির সংগ্রামের কথা তুলে ধরতে গিয়ে মা মাটি মানুষের কথা বললেন। এসব শুনে আমার বেশ একটু গর্বই হচ্ছিল, খুব আনন্দ হচ্ছিল আমার। চোখের সামনে ভেসে উঠছিল দিদির সংগ্রামের মুহূর্তগুলি। সেদিন তার সঙ্গে ছিলেন গুটিকয়েক সাধারণ মানুষ, আর মিডিয়া তো তাকে হারিয়েই দিচ্ছিল। সমাবেশ দেখে অবাক কাশ্মীর থেকে অরুণাচল, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নেতাদের তিনি মঞ্চে আশ্বস্ত করছিলেন আপনারা সব জায়গায় সমাবেশ করুন, বাংলার এই ব্রিগেডের মত সমাবেশ সারা দেশজুড়ে হোক। আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। রাতে টিভি আর আজ সকালে কাগজ দেখে তো আমি অবাক! আমাদের এই দিদিকেই এতদিন তারা পিছিয়ে দিচ্ছিল কেন?
একটু আত্মপ্রচার হবে, কিন্তু আরেকটা কথা না বলে পারছি না। এই সামান্য আলোকচিত্রীর একটা ছবি এখন সারা দেশে ভাইরাল হয়ে গেছে। তা হল, সমাবেশের শেষে উপস্থিত নেতাদের বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে আপ্যায়িত করছেন। নিজের হাতে তিনি তাদের খাবারের প্লেট তুলে দিচ্ছেন। এবং শুধু চন্দ্রবাবু নাইডুর মত প্রবীণ নেতারা নন, তাদের মধ্যে হার্দিক, জিগনেশ, জয়ন্ত, তেজস্বীদের মত তরুণ নেতারাও আছেন। সাংবাদিকদের সারপ্রাইজ এলিমেন্ট কম, কিন্তু এ দৃশ্য আমি নিজেও কল্পনা করতে পারিনি। দীর্ঘ চেষ্টার পর মহাসমাবেশ যিনি সফল করলেন তাকেই চোখের সামনে দেখছি ভারত নামে একটি পরিবারের একজন স্নেহশীল দিদি কিংবা দায়িত্বশীল প্রধানের ভূমিকায়। এ দৃশ্য জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না।
১৯শের মহাসমাবেশ এখন ঢুকে পড়েছে ইতিহাসে। তা ঠিক করে দিয়েছে ভারতীয় রাজনীতির অভিমুখ। বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত, নিজের নিজের এলাকায় ছোট ছোট আঞ্চলিক স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকা দেশের নেতা ও শাসকদলের সামনে তিনি তুলে ধরেছেন একটা জাতীয় প্রেক্ষিত। স্বাধীনতার আগে বাংলার বরেণ্য দেশনেতারা ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন। এরথেকেই জন্ম নিয়েছিল হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে… কথাটি। বহু বছর পর সেই কাজটি করার মধ্যে দিয়ে তৃণমূল নেত্রী জাতীয় রাজনীতিতে বাংলার প্রাসঙ্গিকতা ফিরিয়ে আনলেন। আমি কোন তুলনায় যাবো না কিন্তু এটা আমায় বলতেই হবে দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে কিংবা প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাজ্যে বছরের পর বছর ক্ষমতায় থেকেও বহু বিজ্ঞাপিত অনেক নেতাও একাজটা করতে পারেননি। কারণ, সঙ্কীর্ণ স্বার্থ তাদের বড়ভাবে ভাবার ক্ষমতাটাই কেড়ে নিয়েছিল। বিজেপির অপশাসনের সামনে বিরোধী নেতারা যেন একটু কুঁকড়ে গিয়েছিলেন। তারা কোন দিশা পাচ্ছিলেন না। সেই দিশাটি ধরিয়ে দিলেন তৃণমূল নেত্রী। গতকালের সভায় দেশের সব নেতারা এই সমাবেশের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য দিদির প্রশংসা করছিলেন তখন সত্যিই আমার ভেতর থেকে খুব আনন্দ হচ্ছিল।
সমাবেশে দিদি সবাইকে এগিয়ে দিয়েছেন। নানা রাজ্য থেকে এসে বাংলায় শান্তিতে বাস করা বহুভাষী মানুষের কাছে দেশের বিরোধী নেতারা তুলে ধরেছেন তাদের বক্তব্য ও চিন্তাভাবনার কথা। মঞ্চে খুব কাছ থেকে থাকার সুবাদেই দেখছিলাম প্রবীণ নেতারা তো বটেই, হার্দিক, জিগনেশ, অখিলেশ, তেজস্বী, কেজরিওয়ালের মত তরুণ তুর্কীরাও জনসমাবেশের চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেছেন। এতবড় একটা মঞ্চে দিদি তাদের বক্তব্য রাখার সুযোগ করে দেবেন এটা তারা ভাবতেই পারেননি। তৃণমূল নেত্রী তরুণ নেতৃত্বকে যেন ভারতের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন।
তবে সত্যি কথা বলতে কী আমার একটা ছোট দুঃখও আছে। মহাসমাবেশের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য প্রশংসা বর্ষিত হলেও যিনি এই উদ্যোগের সূচনা করলেন বিজেপির বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে তাকেই প্রধান নেত্রী করে এগোনোর কথা তেমন করে কেউ বললেন না! তবে লড়াইয়ের ময়দানই নেতা তৈরি করে দেয়। দিদির জীবনই তার প্রমাণ। তার সংগ্রামই তাকে দেশজোড়া বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের প্রধান নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )