বহুদিন পর শৃঙ্খল মুক্ত হতে চলেছে দেশের রাজনীতি। দল, পরিবার, আঞ্চলিকতা, ধর্ম, গোষ্ঠী ইত্যাদি নানা শৃঙ্খলে বাঁধা ভারতীয় রাজনীতি অবশেষে বলছে দেশের কথা, ঐক্যবদ্ধ ভারতের কথা। জাতীয় রাজনীতির এ এক সন্ধিক্ষণ। সফল হতে চলেছে বাংলার সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা ছোটখাটো মহিলার এক বিরাট স্বপ্ন ইউনাইটেড ইন্ডিয়া, ঐক্যবদ্ধ ভারত। এই ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বপ্ন বুকে নিয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। বহু কষ্টে অর্জিত সেই স্বাধীন ঐক্যবদ্ধ ভারতকেই ধর্মীয় জিগির তুলে টুকরো টুকরো করে খেলায় মেতেছে বিজেপি। সেই দানবীয় শক্তিকে পরাস্ত করতে দেশের সব প্রধান রাজনৈতিক দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইউনাইটেড ইন্ডিয়া সেই লড়াইয়ের মূল মন্ত্র।
আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বাস করেন দল নয়, দেশ আগে। তাই ব্রিগেডে ১৯এর এই মহাসমাবেশের মঞ্চে কোন তারকা নেতাদের ছবি নয়, নয় কোন পরিবারতন্ত্রের স্তুতি, বিদেশী নেতাদেরও ছবি নয়, মঞ্চের পটভূমিতে শুধু থাকবে দেশের মানচিত্র, তার ওপরে লেখা থাকবে – ইউনাইটেড ইন্ডিয়া। অর্থাৎ সবার আগে দেশ, দেশ বাঁচলেই মানুষ, দল, নেতা, মন্ত্রী সবাই বাঁচবেন। দেশকে দলের আগে রাখার এমন স্পষ্ট ও সহজ ঘোষণা আমি আমার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে দেখিনি। কোন বিরাট স্লোগান নয়;� তীক্ষ্ণ বিধ্বংসী বক্তৃতাও নয়; চিবিয়ে চিবিয়ে বলা পরিসংখ্যান বা উদ্ধৃতি ছাড়াই এভাবে আমাদের দিদি বেঁধে দিলেন ১৯এর ব্রিগেডের সুর।
এই সুরই বেঁধে দেবে দেশের আগামী রাজনীতির গতিপথ। আগামি ভোটে তা পরিণত হবে গর্জনে। দেশের মানুষ অপদার্থ, বেইমান, তঞ্চক মোদী-অমিত এন্ড কোং এর কাছে জানতে চাইবে – তুমি কী সবার আগে দেশকে রাখো? দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থরক্ষা এবং তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়াই কী তোমার রাজনীতি? তাহলে জিএসটি কেন? কেন ডিমনিটাইজেশন? কেনই বা কৃষিঋণ মুকুব না করে দেশের লক্ষ লক্ষ কৃষককে তুমি আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিলে? কেনই বা সাম্প্রদায়িক বিরোধ জিইয়ে তোলার জন্য বৈধ নাগরিকদের তুমি দেশ থেকে উচ্ছেদ করলে? নীরব, মেহুলদের মত দেশের লুটেরাদের কেন বিদেশে পালিয়ে যেতে দিলে? এই প্রশ্নের কোন জবাব বিজেপির কাছে নেই। তাই তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে দেশকে আবার ভাঙতে চাইছে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐক্যবদ্ধ ভারত বা ইউনাইটেড ইন্ডিয়ার স্লোগান তাই হয়ে উঠবে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে মহাজোটের মন্ত্র।
জোঁকের মুখে নুন দেওয়ার মতই এই মন্ত্রে কুঁকড়ে যাবেন বিজেপির থিংকট্যাঙ্করা। কারণ, এই প্রশ্নগুলি তাদের সামনে কেউই এত সহজ সরল অথচ বলিষ্ঠভাবে কেউ করেননি। বিজেপির বিভেদপন্থার বিরোধিতায় গোটা দেশের রাজনীতিবিদদের এভাবে একত্র করার কথা ভাবেননি কেউ। দেশ বাঁচানোর এমন অভিনব স্লোগান আগে কারও মাথায় আসেনি। আমি কেন, গোটা দেশ আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর মানসিক শক্তি ও দূরদর্শিতা দেখে অবাক। ১৯৯৩এর ব্রিগেডে বামেদের মৃত্যুঘন্টা দেখে বাজারি কাগজের অনেক বিখ্যাত কলমচী ও রাজনৈতিক পণ্ডিতরা উপহাস করেছিলেন। এখন তাদের অনেকেই দিদির অনুগ্রহপ্রার্থী। বামেদের বিদায় নেওয়ার পর আমার একদা সহকর্মী অনেককেই হাত কামড়াতে দেখেছি। আজকে যারা বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশে বিরোধী দলগুলির এই মহাসমাবেশ নিয়ে হাসিঠাট্টা করছেন তাদের অবস্থাও যে একইরকম হবে এ নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।
বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভারতের এই লড়াইয়ে দল, উপদল, গোষ্ঠী, ক্ষমতা, বিভেদের কোন জায়গা নেই। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যারা বিজেপিকে পরাস্ত করতে চান তারা সবাই এই লড়াইয়ে আসবেন। এটাই সময়ের ডাক এবং এই মুহূর্তের কর্তব্য। বিজেপির অপশাসন এমনিতেই আমাদের অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। এখনি এই কাজ না করা গেলে পরে করা খুব কঠিন হবে। ব্রিগেডে মহাসমাবেশের আয়োজন করতে গিয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের বিরোধী দলগুলির নেতাদের কাছে ঠিক এই প্রশ্নটাই তুলে দিয়েছেন। তার ভাবনায় ভারত মানে শুধু হিন্দুর ভারত নয়, মুসলমানের ভারত নয়, বিজেপির ভারত নয়, কংগ্রেসের ভারত নয়, কোন পরিবারের ভারত নয়, কোন সঙ্ঘের ভারত নয়, এটা মানুষের সাধারণ ভারত। যেখানে প্রত্যেকের স্বাধীন ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ও বেঁচে থাকার সুযোগ থাকবে। কোন বিভেদের বিষবাস্প মানুষকে কলুষিত করবে না।
৭৭এর মহাসমাবেশের সঙ্গে এই সমাবেশের তুলনা নিরর্থক। কারণ, এই মহাসমাবেশ একদলকে সরিয়ে অন্যদলকে আনা নয়। এটা হল দেশের ঐক্য ও অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য বিজেপির মত একটা সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে দেশের ছোট বড় রাজনৈতিক দলগুলির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের একটা মঞ্চ। সিপিএমের মত কোন প্রাচীন রেজিমেন্টেড পার্টির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কোন ফ্রন্ট নয়, তৃণমূলের মত একটি দলের নেত্রীর একক প্রয়াসে প্রায় বছরখানেক চেষ্টার পরিণতিতে এই মহাসমাবেশের মঞ্চে দেশের প্রতিটি প্রান্তের বিরোধী দলগুলিকে আনা গেছে। এই মঞ্চে আসা সবাই দেশের একেবারে সামনের সারির নেতা। ফারুক আবদুল্লা বা শারদ পাওয়ারের মত নেতারা ১৯৮৪তে সিপিএমের কনক্লেভেও ছিলেন।
নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রাভঙ্গ করা সিপিএম নামক দলটির এখন সাপের ছুঁচো গেলার মত অবস্থা। তাদের দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বক্তব্যের সঙ্গে রাজ্য নেতৃত্বের বক্তব্যের সুর মিলছে না। অন্যদিকে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব এই মহাসমাবেশে না এলেও কংগ্রেস কর্ণধার রাহুল গান্ধী বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর এই আওয়াজকে চিঠি দিয়ে লিখিত সমর্থন জানিয়েছেন। প্রদেশ নেতৃত্ব না এলেও মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং অভিষেক মনু সিংভির মত নেতাদের এই মহাসমাবেশে পাঠিয়েছেন তিনি।
আমি একজন সামান্য আলোকচিত্রী। রাজনীতির মারপ্যাঁচ অত বুঝিনা। আমার মনে হয় স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আর কোন দলীয় মঞ্চ থেকে দেশকে সবার আগে রাখার এমন আওয়াজ আর ওঠেনি। এখানেও এগিয়ে রইলো বাংলা। বাংলার তৃণমূল নেত্রী দেশের রাজনীতিতে বাংলার গুরুত্ব আবার প্রমাণ করে দিলেন। গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাওয়া বিরোধী রাজনীতিকে দিলেন এক নতুন দিশা। ১৯এর ব্রিগেডের মহাসমাবেশ রাজনীতির চেনাছক থেকে এক মুক্তির ডাক।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )