আপনার খেলার স্টেডিয়ামে জনগনমন শুনলে মেরুদন্ড সোজা হয়ে ওঠে? আপনার এআর রহমানের গলায় বন্দে মাতরম শুনলে গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে যায়? আপনার পাকিস্তানের ওপর রাগ হয় মুম্বাইয়ের মতো কোন সন্ত্রাস হামলার পর? আপনি ফি প্রজাতন্ত্র দিবসে টিভির সামনে বসে প্যারেড দেখেন? আর প্লাস্টিকের পতাকা অফিসের টেবিলে লাগান? আর যতবারই রোজা, বর্ডার, লাগান, গদার, লক্ষ কোন চ্যানেলে দিক না কেন, হাঁ করে দেখেন? হাজার বার দেখেন, কাঁদেন আর মনে মনে বিড়বিড় করেন, দুধ মাংগো গে তো ক্ষীর দেংগে, কাশ্মীর মাংগো গে তো চিড় দেংগে। তবে উড়ি আপনার জন্য। তবে আড়াই ঘন্টা আপনি টানটান হয়ে দেখবেন, সিটি মারবেন, তেমন হলে স্যালুট ও মেরে দিতে পারেন৷ এর সাথে মোদীভক্তি, চাড্ডিপনা, জাতীয়তাবাদের কোন সম্পর্ক নেই৷ এ আবেগ ওয়াঘা সীমান্তে ঘুরতে গেলে ও আসে মধ্যবিত্ত দেশবাসীর। দেশত্ববোধ মাস্টারদা সূর্যসেনের ও ছিল। আজ তার মৃত্যুদিন। তাঁর চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের গল্প যেমন রোমহর্ষক, সার্জিকাল স্ট্রাইকের গল্পটা ও তাই।
চিতাবাঘের পেচ্ছাপ খুঁজতে হয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। বোতলে করে চিতাবাঘের পেচ্ছাপ নিয়ে পাকিস্তান গেছিল এরা৷ কারণ যে যে বাংকারগুলো উড়িয়ে দিতে হতো, তা যাওয়ার রাস্তায় প্রচুর কুকুর ছিল। চিল চিৎকার করতো পল্টন দেখলে৷ এরা চিতাবাঘের গায়ের গন্ধ চেনে৷ পেচ্ছাপের ও৷ তাই চিতাবাঘের পেচ্ছাপ ছড়াতে ছড়াতে সেনাবাহিনী এগিয়েছিল। না এটা সিনেমাতে দেখানো হয়নি৷ এরকম অনেক বাস্তব ঘটনাই দেখানো হয়নি সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়ে। দেখালে একটা দলিল হয়ে থাকতো এ ছবি৷ নেটফ্লিক্স এ দশবছর পরে ও মানুষ দেখতো, যেমনভাবে ওসামা বিন লাদেনকে মারার ছবিটা দেখে৷ কিংবা মোসাদ নিয়ে কোন ডকুমেন্টারি। টানটান দেখে।
এ ছবি সিম্বার দেশত্ববোধক প্রতিরূপ। আর্কাইভাল মুল্য শুন্য কিন্তু এন্টারটেইনমেন্ট একশোতে একশো। সাথে কিছু ট্যাক্স ছাড় ইত্যাদি পেতে তোষামোদ ও আছে। বাস্তবজীবনের কোন চরিত্রকে নিয়ে কোন পেঁয়াজি করা হয়নি। অজিত ডোভালকে কিনা একদমই না। উনি প্রায় খ্রিস্ট আসন গ্রহন করেছেন এখানে। নয়তো পরেশ রাওয়ালের মতো অসামান্য অভিনেতা থাকতে ও কোন কমিক রিলিফ দেওয়া হয়নি। সুযোগ থাকলে ও। যেমন একটি সিনে অজিত ডোভাল লুকিয়ে ফাইভ স্টার হোটেল থেকে অটোতে চেপে রাইসিনা হিল যাবেন৷ দিল্লিতে যে কেউ জানবে বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হলে ও ওই অটো কলকাতার হলুদ ট্যাক্সির মতন মানা করবে যেতে। এখানে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী আমলা অটোতে চেপে গেল সার্জিকাল স্ট্রাইকের খুঁটিনাটি আলোচনা করতে করতে।
এখানে মোদী সাহেবকে নিয়ে ও পেঁয়াজি করা হয়নি৷ হলে বোধহয় বলিউডের সাথে সেল্ফিটা পোস্ট করা হতো না। দূরদর্শনের আদী বোমকেশ হিসেবে পরিচিত রজিত কপুর এখানে মোদী। নিজের মতো অভিনয় করেছেন। অনুপম খের এর মতো মিমিক্রি করতে হয়নি। রাজনাথ ও অরুন জেটলির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যারা তারা সামান্য করলে লোকে হো হো করে হেসেছে৷ ভোটার বুদ্ধিমান। স্থুল প্রোপাগান্ডা আর চলবে না।
‘রঙ দে বসন্তী’ ছবিতে একটা দৃশ্য ছিল গান করতে করতে খোলা জিপের ওপর উঠে মত্ত দামাল ছেলেমেয়েগুলো ইন্ডিয়া গেটকে স্যালুট করবে আর প্রদক্ষিন করবে পুরোটা। আটকে গেছিল শুটিং। এটা হওয়া অসম্ভব। তখন প্রনব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি। পরিচালক ছুটলো দাদার কাছে ফরমায়েশ করতে৷ পুরো ছবির স্ক্রিপ্ট, রোল দেখে রাষ্ট্রপতি সেনাবাহিনীকে বলেছিল এ ছবি আটকে গেলে একটা ভালো ছবি দেখা থেকে বঞ্চিত হবে দেশ। দেওয়া হোক অনুমতি। বাকিটা ইতিহাস৷ ও ছবিতে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে খুন করা হয়েছিল। দেশে দ্রোহের বাতাবরণ দেখিয়েছিল পরিচালক। ছবিটা কিন্তু আটকানো হয়নি।
উড়িতে এমন কিছু নেই৷ প্রত্যেকটা সিনে চুপচুপে দেশত্ববোধ, সরকারি আনুদত্য। দেশ, দেশের সরকার দেবতুল্য। রাজণীতি থেকে দশহাত দূরে থেকে একটা মুচমুচে ছবি এটা। ওই যেমন সানি দেওলের ছবি হয়৷ যেখানে চোদাবোকা হয় পাকিস্তান আর খিল্লি ওড়ানো হয় আইএসআই কে। আদপে ওরাই সমুদ্র পথ দিয়ে দশটা ছেলে মুম্বাই পাঠিয়ে গোটা দেশের মেরুদন্ড ভেঙে দেয়, উড়িতে গুমন্ত অবস্থায় দু ডজন সেনা মেরে দেয়। বাস্তবে দিতে পারে। কিন্তু সিনেমাতে ওরা জোকার আর আমরা ওদের খিল্লি করি।
যাদের সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়ে সন্দেহ আছে, তারা এ ছবিটা দেখতে পারেন। কারণ স্ট্রাইকটা সত্যি হয়েছিল এবং তার নেপথ্যে কি কি ঘটেছিল মোটামুটি দেখানো এতে। যদি ও শাহরুখ- করিনা কপুরের অশোকা যেমন রাজা অশোকের ইতিহাস নিয়ে ছেলেখেলা করেছে, এ ছবি ও অনেকটা তাই করেছে সার্জিকাল স্ট্রাইকের ইতিহাস নিয়ে। চিত্রনাট্যকারকে ওয়ানপয়েন্ট ব্রিফ দেওয়া ছিল বোধহয়, ভারতীয় সেনাকে মার্কিন সেনা আর ইজরাইলী মোসাদের একটা ককটেল দেখাতে হবে৷
ছবি শেষ হতে দিল্লির এই হলে লোকে হাততালিতে ফেটে পরে। সার্জিকাল স্ট্রাইকের জন্য না। পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করা গেছে বলে। বাইশ গজে হলে ও বোধহয় একই ভাবে হাততালিতে ফেটে পরতো৷ মাথায় রাখবেন এটা ২০১৯। এই আবেগ ১৯ এ কাজে লাগবে সাদা দাড়ি রজিত কপুরেরা। লাগাবেই।
পুনশ্চঃ এ সপ্তাহে যদি একটা ছবি সপরিবারে দেখার রেস্তো থাকে তবে উড়ি দেখুন। একসিডেন্টাল প্রাইমিনিস্টার না দেখলে ও চলে। পরের সপ্তাহে চলবে কিনা বলতে পারছিনা। ছবিটা শ্রেষ্ঠ ম্যানারিজমের জন্য সবকটা পুরস্কার হয়তো নিয়ে নেবে কিন্তু আদপে চলচ্চিত্র হিসেবে ঝুলস্য ঝুল।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )