কাজের মধ্যে থাকতে থাকতে একেকটা বছর কীভাবে কেটে যায় তা বুঝতে পারিনা। ইদানিং মাঝে মধ্যে সেই লম্বা, কালো ছায়াময় মানুষটারটার সঙ্গে দেখা হয়। সে মুচকি হেসে বলে কী রে আর কতদিন? ঠাকুমার কাছ থেকে শোনা গল্পের যমদূতের কথা মনে পড়ে আমার। ঠাকুমা বলতো, ও নাকি মানুষকে নিতে আসে। তবে কি মৃত্যুর সঙ্গে আমার দূরত্ব কমছে? গতকাল সকালেই ভাবছিলাম ওকে বলবো আমাকে ২০১৯ আর ২১ পর্যন্ত সময় দাও। তারপর আর তোমায় আসতে হবে না আমি নিজেই চলে যাবো। এসব নিয়ে গতকাল ফেসবুকে একটা পোস্টও করেছি। গতকাল ছিল আমার জন্মদিন। কালকের দিনটাও আমার ব্যস্ততার মধ্যে কাটলো। ২০১১সালের পর থেকে এই নিয়ে পরপর চারবার আমি জন্মদিনে দিদির কোন না কোন অনুষ্ঠানের কাজে বাইরে কাটালাম। দিনটা যে কীভাবে কেটে যায় বুঝতেই পারিনা। এই বিশেষ দিনে দিদির একটা শুভেচ্ছা এতদিন আমার বাড়ির ঠিকানায় চলে আসতো। গতকাল সকালে আমাদের নবান্নর ওএসডি বিনায়ক দিদির একটা শুভেচ্ছা বার্তা আমার হাতে তুলে দিতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। এর আগের তিনবার জন্মদিনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সার্কিট হাউসে উঠতেন সেখানে কিংবা মঞ্চে কোন অনুষ্ঠানের আগে ও পরে তাকে প্রণাম করেছি। গতকালও তার এত ব্যস্ততার মধ্যে ভাবছিলাম, কখন প্রণামটা সারবো। কিন্তু তার ব্যস্ততায় আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। কি করবো ঠিক করতে পারছিলাম না, একটু ভয়ও করছিলো।
গতকাল দিনের শুরুর থেকেই দিদি ছিলেন সাংঘাতিক ব্যস্ত ও আক্রমণাত্মক মেজাজে। এত দ্রুত তিনি মঞ্চে ঢুকে সরকারি কাজ শুরু করে দিলেন যে আমি আর কিছু বলার সুযোগই পেলাম না। প্রতিটি কথায় মোদীকে তুলোধোনা করছিলেন তিনি। ভাবছিলাম সার্কিট হাউস ছাড়া প্রণাম করা যাবে না। আমার হাতে ক্যামেরা, দিদির এমন ব্যস্ততা, কাজ বন্ধ করে প্রণাম করবো কীভাবে? এখানে বলে রাখি প্রতিটি জন্মদিনে আমি মা বাবা আর দিদিকে প্রণাম করি। যাইহোক, এরকম সাতপাঁচ ভেবে ঠিক করলাম শেষে একবার চান্স নেবো। কিন্তু দিদির ভাষণ শেষ হওয়া মাত্র দলের নেতা নেত্রী, প্রশাসনিক আধিকারিক সব মিলিয়ে জনা তিরিশেক মানুষ তাকে এমনভাবে ঘিরে ধরলেন যে, আমার মত ছোটখাটো মানুষ তার কাছে ঘেঁষতেই পারলাম না। দূরে মঞ্চের পিছনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, সন্ধ্যায় সার্কিট হাউসে একবার শেষ চেষ্টা করবো।
ঠিক এইসময়, দিদি জটলা থেকে বেরিয়ে মঞ্চ থেকে নামার সময় ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে দু-পা এগিয়ে এসে বলে উঠলেন – অশোক শুভ জন্মদিন। ভেবেছিস কী আমি ভুলে গেছি, দ্যাখ তোকেই মনে করিয়ে দিলাম। কাজের চাপে তো ভুলেই গিয়েছিলি। তারপর সেই চেনা হাসিমাখা মুখেই বলে উঠলেন, ভালো থাক খুব ভালো থাক। বললাম দিদি দাঁড়াও, তোমায় একটা প্রণাম করবো। এই বলে ঝুঁকে তার দুটি পায়ে দুহাত রাখলাম। দিদির ডানহাত আমার মাথায়। আমার চোখ তখন ঝাপসা হয়ে এসেছে। সময়টা যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। আমার কিছু বলার ক্ষমতা ছিলনা। মনে মনে বলে উঠলাম, আমার এই দিদিই যেন অসংখ্য মানুষের বিশ্বাস, ভালোবাসা আর আশীর্বাদ নিয়ে দেশের মানুষের জন্য আরও বড় দায়িত্ব পালন করতে পারেন। আমার বিশ্বাস আমার মত আরও অনেক ছোটোখাটো সাধারণ মানুষের স্বপ্ন ও ইচ্ছা সফল হবেই। সেদিন খুব একটা দূরে নয়।
শিশুদের পুরষ্কার দেওয়ার সময় মঞ্চে দাঁড়িয়ে একটা টেডি বিয়ার হাতে নিয়ে শিশুর মত হাসছিলেন দিদি। সেই হাসিতে ঝরে পড়ছিল ছোটদের প্রতি তার স্নেহ আর ভালোবাসা। আমার মনে হল সেই শিশুদের দলে যেন আমিও রয়েছি। টেডি বিয়ারটা যেন তিনি আমাকেই দিচ্ছেন! মনটা ভালো হয়ে গেলো। আমার জন্মদিনে এরথেকে ভালো উপহার আর কী হতে পারে?
রুমে ফিরে দেখি তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন মিষ্টি পাঠিয়েছে। কোন আধিকারিক পাঠিয়েছেন কেক, একজন পাঠিয়েছেন কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণির বিখ্যাত পুতুল। অনেকে পাঠিয়েছেন কার্ড। ফুল বাদে আর সবকিছুই ছিল। সেটাও পূর্ণ হল। আমাদের সরকারি গাড়ির দুজন পাইলট হরি ও জয়দেব ফুল আর মিষ্টি দিল। সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে থেকেও পেয়েছি অসংখ্য শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। তাদের সবার জন্য শ্রদ্ধা, প্রণাম আর বুকভরা ভালোবাসা রইলো। বড়দের কাছে চাই আশীর্বাদ, আর ছোটরা আমার ভালোবাসা নিও। আমি যেন তোমাদের সবার শুভ কামনার যোগ্য হয়ে উঠতে পারি। মনে পড়ে গেল মনোজদার লেখা মৃত্যুর চোখে জল নাটকটার কথা। ভাবছিলাম এত ভালোবাসার বর্ম কী মৃত্যু ভেদ করতে পারবে? সবাই ভালো থাকবেন।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )