পয়লা জানুয়ারি এলে আমার মনে পড়ে কল্পতরু উৎসবের কথা। আমি যে বিরাট ধম্মোকম্মো মানি তা নয়, কল্পতরু উৎসবের কথা জানি ছোটবেলায় রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলে পড়েছি বলে। কল্পতরুর দিন রামকৃষ্ণদেব গিরিশ ঘোষ ও অন্যান্য ভক্তদের বলেছিলেন, তোমাদের চৈতন্য হোক।
বিশ্বাস ও ভক্তি নিয়ে বাঁচা সরলমনা ভক্তদের চৈতন্য হতে পারে কিন্তু� প্যাঁচপয়জারে ওস্তাদ একশ্রেনির বঙ্গীয় রাজনীতিবিদদের চৈতন্য হওয়াটা বেশ কঠিন। প্রশ্ন হল, তা হলে তারা কী করবেন? তারা শিখবেন ঘটনা থেকে, অভিজ্ঞতা থেকে আর বাস্তব পরিস্থিতি থেকে। এই তিনটির ভিত্তিতেই তো জগৎসংসারের যাবতীয় মানুষ তাদের কর্তব্য স্থির করে থাকেন এবং ভালমন্দ বিচার করে সিদ্ধান্ত নেন। বাংলার মানুষও তাই করেছেন। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই তাদের বোধোদয় বা চৈতন্য হয়েছিল, সিপিএমের অপশাসন থেকে বাংলাকে মুক্ত করার জন্য সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এক লড়াকু নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতায় এনেছিলেন তারা। ক্ষমতায় আসার পর তারাই সেই নেত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতির সঙ্গে তার কাজগুলিকে মিলিয়ে নিয়েছেন, আরেকবার ক্ষমতায় এনেছেন তাকে। কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, রূপশ্রী, ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার জন্য সাইকেল, বইখাতা এবং পোশাকপ্রদান থেকে শুরু করে এ বছরের প্রথমদিনে কৃষকবন্ধু প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষিঋণ মুকুব ইত্যাদি একের পর এক জনমুখী কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে বাংলাকে পতনের অন্ধকার থেকে উন্নয়নের আলোতে নিয়ে এসেছেন তিনি। কাজের মধ্যে দিয়ে তিনি মানুষের বিশ্বাস অর্জন করেছেন। জীবনের অভিজ্ঞতা ও মুখ্যমন্ত্রীর কাজ তাদের চৈতন্য ফিরিয়েছে।
তবে মানুষের চৈতন্য ফিরলেও একশ্রেণির রাজনীতিবিদদের চৈতন্য ফেরেনি। তারা এখনও সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম ঠিক হয়েছিল বলে প্রচার করে মানুষকে নতুন করে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজ্যের যে উন্নয়ন ও অগ্রগতি হচ্ছে তা তারা বুঝতে চাইছেন না। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কুৎসা করাই তাদের একমাত্র রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা। অথচ তীব্র বাংলা ও বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধী কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী কিছুদিন আগে স্বীকার করেছেন ১০০দিনের কাজের প্রকল্পে সবার শীর্ষে রয়েছে বাংলা। এখানে এই প্রকল্পে সব থেকে বেশি কর্ম দিবস সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রকল্পে এখানেই সব থেকে বেশি টাকা খরচ হয়েছে। ১০০দিনের কাজে সব থেকে বেশি পরিবারকে কাজ দিয়েছে বাংলা। অথচ বাস্তব অবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা চৈতন্যহীন কিছু রাজনীতিবিদ এত দিন বাংলায় ১০০দিনের কাজে ব্যপক দুর্নীতি হয়েছে বলে প্রচার করছিলেন। এদেরও চৈতন্য হোক।
ভারতের মত কৃষিপ্রধান দেশে কৃষকরাই সব থেকে বেশি বঞ্চিত। এই সরল সত্যটা দেশের শাসকরা বোঝেন না। ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদী সরকার এই কৃষক বঞ্চনার নীতিতেই অবিচল ছিলেন। সাম্প্রতিক নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর তারা একটু সুর পাল্টে কৃষকদরদী সাজতে চাইছেন। কৃষি সমস্যা সম্বন্ধে চৈতন্যহীন শাসকদের চেতনায় ধাক্কা দিয়েই বাংলায় চালু হয়ে গেছে কৃষকবন্ধু প্রকল্প। এতে ১৮ থেকে ৬০বছর বয়সী কোন কৃষক বা ক্ষেত মজুরের স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে তার পরিবার ২লক্ষ টাকা পাবেন। রবি ও খারিফ চাষের ক্ষেত্রে প্রতি একরে ৫হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। এই প্রকল্পে উপকৃত হবেন রাজ্যের ৭২লক্ষ কৃষক পরিবার। এরপরেও যারা বলবেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী গরীব মানুষদের জন্য কাজ করেননি, কোন ঠাকুরই তাদের চৈতন্য জাগাতে পারবেন না। অথচ বাংলার মানুষের চৈতন্যে এই উদ্যোগগুলি ছাপ ফেলছে, দিদির পাশে আরও বেশি বেশি করে দাঁড়াচ্ছেন তারা। ফসলের উপযুক্ত দাম না পেয়ে গোটা দেশে ১২হাজার কৃষক আত্মহত্যা করলেও বাংলায় কৃষকদের কোন আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি।
বিজ্ঞানসন্মত ভাবনা ও লাগাতার উন্নয়নমূলক কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে বাংলা নামক বিধ্বস্ত রাজ্যটিকে সামনের সারিতে নিয়ে এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার মতে তিনিই আগামী দিনে গোটা দেশকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এই লড়াকু নেত্রীকেই আমরা দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাই। একথা জোর গলায় বলার মত চৈতন্য বিরোধীদের কবে হবে আমি জানি না। তবে কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রধানমন্ত্রী করা যেতে পারে সে বিষয়ে কতগুলি সামান্য যুক্তি পেশ করতে চাই।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলা যে ভাবে বঞ্চিত হয়েছে, নেতৃত্বদানের সবরকম যোগ্যতা থাকা সত্বেও বাংলার রাজনীতিবিদদের যে ভাবে পিছনে টেনে রাখা হয়েছে এ ঘটনায় তার প্রায়শ্চিত্ত করা যাবে। বিরোধী জোটে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদের দাবীদার হিসেবে যে নামগুলি ঘোরাফেরা করছে আমাদের লড়াকু নেত্রী তারমধ্যে সবচাইতে উপযুক্ত। কোন পারিবারিক তকমা তার নেই, তিনি উঠে এসেছেন নিজের লড়াইয়ের জোরে। বিরোধী জোটের নেতাদের মধ্যে রাজ্যে তার গণভিত্তি ও গ্রহণযোগ্যতা সবথেকে বেশি। দেশের বেশিরভাগ দলের নেতা ও নেত্রীদের কাছে তার ভাবমূর্তি সবচেয়ে উজ্জ্বল। একইসঙ্গে তার কেন্দ্র ও রাজ্যে সরকার ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর সফলভাবে চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। লোকসভা ভোটেও অন্যান্য রাজ্যে শাসক ও বিরোধী দলগুলির মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও বাংলায় তা হবে না। এখানে তৃণমূলই অধিকাংশ লোকসভা আসনে জয়লাভ করবে। এ জয় বিরোধী জোটের আসনসংখ্যা বাড়াবে।
উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে ধাক্কা খাওয়ার পর বিজেপি পূর্ব ভারত থেকে নিজেদের আসন বাড়াতে চাইছে। আগামী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ঘোষণা করে লড়াই হলে বঞ্চিত বাঙালি হাত উজাড় করে তাকে ভোট দেবেন। এই ঘটনা কিন্তু অন্য কোন নেতা বা নেত্রীর ক্ষেত্রে ঘটবে না। এমনকি সিপিএমও এক্ষেত্রে তার বিরোধীতা করতে পারবে না কারণ তাহলে তার বঙ্গবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয় থাকবে।
বিরোধীদের চৈতন্য হোক। বাংলার স্বার্থেই তারা এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাবে সন্মতি দিন। কাঁকড়ার মত তাকে পিছনে টেনে রাখার চেষ্টা থেকে বিরত হন। দেশ তো বটেই বাংলা, বাঙালি এবং রাজ্যের স্বার্থেই আমরা তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাই। তিনিই যোগ্যতমা, বাংলার বঞ্চনার ইতিহাসের আর পুনরাবৃত্তি করবেন না। রাজীবের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রণববাবুর নাম শোনা গিয়েছিল। আমাদের সেই শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। অথচ সেই সময় তিনিই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য যোগ্যতম ব্যক্তিত্ব। এরপর এল কারাটদের জ্যোতিবাবুর প্রধানমন্ত্রীত্ব আটকে দেওয়ার ঘটনা। আর যেন তেমন কোন ঐতিহাসিক ভুল না হয়। আপনাদের চৈতন্য হোক।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )