একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারের শুরু থেকেই বাংলাদেশের ভোটারদের কাছে বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্টের আহ্বান ছিল, ভোটকেন্দ্রে যাবেন ভোট দেবেন। প্রয়োজনে কেন্দ্র পাহারা দেবেন। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়েছেন, ভোটও দিয়েছেন। যার ফলাফল, প্রায় একশো শতাংশ আসন নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতল আওয়ামি লিগ।
ভোটের দিন সকালেও বিএনপি ঐক্যফ্রন্ট নেতারা ভোটের বিষয়ে কিছু আপত্তিকর কথা মুখে বললেও তাঁদের মনে অনেক আশা ছিল। কিন্তু সব হিসেব ওলটপালট করে দিলেন বাংলাদেশের ভোটাররা। উঠল ভোটের জোয়ার। সেই জোয়ার পরিণত হল সুনামিতে। ফলে আওয়ামি লিগ জোটের পক্ষে বাংলাদেশের ৩০০ সংসদীয় আসনের ২৮৮টি আসন। অন্যদিকে, বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট মিলে আসনের সংখ্যা ৭৩ নির্দলেরা পেলেন ৪টি আসন। প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে একটি আসনে নির্বাচন বাকি।
এবারের ভোটে বাংলাদেশে মূল ইস্যু ছিল দু’টি। একদিকে, আওয়ামি লিগ ও মহাজোটের উন্নয়ন এবং মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতার বাংলাদেশ। অন্যদিকে, সদ্য রেজিস্টার বাতিল করা জামাতেকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্টের ইস্যু ছিল, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও খালেদা জিয়ার মুক্তি। ভোটের আগে প্রায় প্রতিদিনই তারা জনগণকে ভোটকেন্দ্র পাহারা দিতে বলেছিল। কিন্তু জামাতের সঙ্গে জোট করা হল কেন? তা নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের প্রধান কামাল হোসেনকে গত ১৪ ডিসেম্বর সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তাঁর অসহিষ্ণু হয়ে ওঠা এবং ‘খামোশ’বলে সাংবাদিকদের থামিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সারা দেশে সমালোচনার ঝড় তোলে। পরে এ বিষয়ে কামাল লিখিত বিবৃতি দিয়ে দুঃখপ্রকাশ করলেও বিষয়টির ছাপ থেকে যায় জনতার মনে।
বিএনপি-সহ ঐক্যফ্রন্ট তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া জারি রাখার কথা বলেছিল। কিন্তু তারপরেই ঐক্যফ্রন্টের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি যে নির্বাচনী ইস্তেহার প্রকাশ করে তাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কোন কথাই লেখা হয়নি। একই জোটের দুই ধারা বিভ্রান্ত করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে। অন্যদিকে, তরুণ প্রজন্মের হাসির খোরাক হয়ে ওঠে ঐক্যফ্রন্টের ইস্তেহারের আরেকটি ঘোষণা। বলা হয়েছিল, ‘সঠিক কক্ষপথে নতুন স্যাটেলাইট প্রেরণ করা হবে।’ ক’দিন আগেই বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে বাংলাদেশের উৎক্ষেপিত স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এমন গুজবের পরপরই ঐক্যফ্রন্টের সঠিক কক্ষপথ বাক্যাংশটি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে নতুন প্রশ্নের খোরাক জোগায়।
আর একটি প্রশ্নও সবার মুখে মুখে ছিল। ঐক্যফ্রন্ট এবং বিএনপি যে সরকার গঠন করার কথা বলছিল তাতে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? এর উত্তরে কামাল জানিয়েছিলেন, নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে থেকেই কেউ প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু বিএনপি এই ইস্যুতে স্পষ্ট কোন জবাব দেয়নি। ঐক্যফ্রন্টের আর এক শরিক দলের নেতা কাদের সিদ্দিকির হুঙ্কার ছিল,‘নির্বাচনের পর ২ জানুয়ারি তিনি জেল ভেঙে খালেদা জিয়াকে বের করে আনবেন’। এই গর্জনটিও ভোটারদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এবারের ভোটে বাংলাদেশে বড় ফ্যাক্টর ছিলেন তরুণ প্রজন্মের ভোটারেরা। নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালে ছবি-সহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের পর থেকে গত ১০ বছরে বাংলাদেশে তরুণ ভোটার বেড়েছে ২ কোটি ২৫ লাখের বেশি। তাদের অধিকাংশের বয়স এখন ১৮-২৮ বছরের মধ্যে। এই তরুণদের বড় একটি অংশ ছিল শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে। এঁরা বহু ইস্যুতে আওয়ামি লিগের সমালোচনা করলেও মুক্তিযুদ্ধ তাদের চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। যে কারণেই সাম্প্রতিককালের বাংলাদেশের দু’টি আলোচিত ঘটনা, কোটা আন্দোলন এবং স্কুলপড়ুয়াদের পথে নেমে আসার সময়েও তাঁদের সবার মুখে স্লোগান ছিল,‘জয় বাংলা’।
এক দশকের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির প্রধান নেত্রী খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে। দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতাও গ্রেনেড হামলা-সহ কয়েকটি মামলায় দণ্ডিত হয়ে লন্ডনে রয়েছেন দীর্ঘ সময়। গ্রেনেড হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্রের চালান, জঙ্গিবাদের সঙ্গে কয়েকজন নেতার সম্পর্ক, জামাতের রেজিস্টার বাতিলের পরও নিজেদের দলীয় প্রতীক ধার দিয়ে সেই দলটিকে রক্ষার চেষ্টা করা-সহ অনেকগুলো ঘটনার দায়ও বিএনপিকে এবারের নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল বড়সড় প্রশ্নের মুখে। এই কারণেই বাংলাদেশের এই ভোট-প্লাবনে এবার আর কোনও রাজনৈতিক দল দাড়াতেই পারেনি হাসিনার আওয়ামি লিগের সামনে।