‘কেয়া হুয়া, তেরা ওয়াদা’, ‘লিখে যো খত তুঝে’, ‘চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে যো দিলকো’ এই সমস্ত গানগুলো আজও বহু মানুষের ফোনের প্লে-লিস্টে স্থায়ী ভাবে থাকে। বিভিন্ন রেডিও চ্যানেল এই গানগুলোকে আজও অন এয়ার করে। যে সময়ে খুব কম গানই মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারে, সেই সময়ে এতগুলো দিন পরেও স্বর্ণযুগের গান নিয়ে সঙ্গীত প্রেমী মানুষের মনে চির অমর হয়ে রয়েছেন মহম্মদ রফি। জীবিত থাকলে আজ তাঁর বয়স হত ৯৪ বছর। সশরীরে না থেকেও আজও তিনি উজ্জ্বল উপস্থিতিতে রয়ে গেছেন।
সমগ্র উপমহাদেশেই অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। সঙ্গীত জগতে অসামান্য অবদানের ফলে শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে জাতীয় পদক এবং ৬-বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন রফি। এছাড়াও, ১৯৬৭ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মশ্রী সম্মানেও অভিষিক্ত হয়েছেন তিনি। তাঁর কণ্ঠ ছিল ভীষণ বইচিত্রমঅয়, বহুবিধ গানে অংশ নেওয়ার বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, দেশাত্মবোধক গান, বিরহ-বিচ্ছেদ, উচ্চ মার্গের প্রেম-ভালবাসা, কাওয়ালী, ভজন, গজল-সহ বিভিন্ন গোত্রের গানে দক্ষতা ও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন সমানভাবে। বিশেষ করে হিন্দি এবং উর্দু ভাষায় সমান দক্ষতা থাকায় তার গানগুলোতে বৈচিত্র্যতা এসেছে খুব স্পষ্ট ভাবে।
১৩ বছর বয়সে রফি লাহোরের প্রথিতযশা শিল্পী কে এল সাইগলের সঙ্গে জীবনের প্রথম শ্রোতাদের মুখোমুখি হয়ে গান পরিবেশন করেন। ১৯৪১ সালে শ্যাম সুন্দরের নির্দেশনায় লাহোরে চলচ্চিত্রের গায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটে। পরের বছর বোম্বের চলচ্চিত্র গাও কি গৌরী চলচ্চিত্রে গান করেন। ১৯৪৯ সালে নওশাদ (চাঁদনী রাত, দিল্লাগী, দুলারী); শ্যাম সুন্দর (বাজার); হুসনলাল ভগতরাম (মীনা বাজার) প্রমুখ সঙ্গীত পরিচালকের নির্দেশনায় একক সঙ্গীতে অংশ নেন। রফি তখনকার বেশিরভাগ নামকরা সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। এর মধ্যে আছেন- নওশাদ, ও পি নায়ার, শঙ্কর জয়কিষাণ ও শচীন দেব বর্মণ।
শচীন দেব বর্মণ বিখ্যাত অভিনেতা দেব আনন্দ এবং গুরু দত্তের মাধ্যমে রফিকে তাঁর নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আমন্ত্রণ জানান। রফি বর্মণের সঙ্গীত পরিচালনায় পিয়াসা (১৯৫৭), কাগজ কে ফুল (১৯৫৯), তেরে ঘর কে সামনে (১৯৬২), গাইড (১৯৬৫), আরাধনা (১৯৬৯) এবং অভিমান (১৯৭৩) চলচ্চিত্রে কাজ করেন। এস. ডি. বর্মণ ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সঙ্গীত পরিচালক যিনি নওশাদের পাশাপাশি মোহাম্মদ রফিকেও তার সুরারোপিত অধিকাংশ গানে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছেন।
হিন্দী চলচ্চিত্র শিল্পে রফি এবং সঙ্গীত পরিচালক শঙ্কর জয়কিষাণের মধ্যে চমৎকার ও গভীর সু-সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। জয়কিষাণের সঙ্গীত পরিচালনা ও নির্দেশনায় রফি বেশ কিছু ছবির গানে কণ্ঠ দেন যা শাম্মী কাপুর এবং রাজেন্দ্র কুমারের ঠোঁটে দেখা যায়। রফি’র ৬টি ফিল্মফেয়ার পদক প্রাপ্তির মধ্যে ৩টিই ছিল শঙ্কর জয়কিষাণের সঙ্গীত নির্দেশনা ও পরিচালনায়। তেরি পিয়ারী পিয়ারী সুরত কো, বাহারো ফুল বর্ষাও এবং দিল কি ঝরোখে মে’র মতো অবিস্মরণীয় গানগুলো তাকে ঐ পদকগুলো প্রাপ্তিতে সহায়তা করেছিল।
ইয়াহু! চাহে কোই মুঝে জাংলী কাহে গানটি ছিল একমাত্র গান যাতে দ্রুতলয়ের অর্কেষ্ট্রা ঘরাণার গান করেছেন রফি। কিশোর কুমারের পরিবর্তে রফিকে সারারাত ছবিতে আজব হ্যায় দাস্তান তেরী ইয়ে জিন্দেগী গানে অন্তর্ভুক্ত করেন শঙ্কর জয়কিষাণ। মোহাম্মদ রফি তাঁর সঙ্গীত নির্দেশনা ও পরিচালনায় সর্বমোট ৩৪১টি গান গেয়েছিলেন, তার মধ্যে ২১৬টি গানই ছিল একক সঙ্গীতের। বসন্ত বাহার, প্রফেসর, জাংলী, সুরজ, ব্রহ্মচারী, এ্যান ইভ্নিং ইন প্যারিস, দিল তেরা দিওয়ানা, ইয়াকিন, প্রিন্স, লাভ ইন টোকিও, বেটি বেটে, দিল এক মন্দির, দিল আপনা আউর প্রীত পারাই, গবন এবং জব পেয়ার কিসি সে হোতা হে ছবিগুলোতে তার গান রয়েছে।
জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মান্না দে রফি সম্পর্কে বলেছিলেন যে, ‘তিনি সকলের চেয়ে সেরা গায়ক ছিলেন। রফি এবং আমি সকল স্তরের গানই গেতে পারি এবং তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন ভদ্রলোক। তিনি আমার চেয়েও সেরা গায়ক ছিলেন এবং আমি অবশ্যই বলবো যে, কেউই তাঁকে স্পর্শ করতে পারবে না। তিনি যখনই যা চেয়েছেন, তা-ই করতে পেরেছেন। আমরা সকলেই একবাক্যে ও কৃতজ্ঞচিত্তে তা স্বীকার করি।’
মানুষ মাত্রেই মরণশীল। তবুও কিছু কিছু মানুষের শুধু দেহের মৃত্যু ঘটলেও তাঁদের কাজের মধ্যে দিয়েই তাঁরা আজীবন বেঁচে থাকেন। রফিও এমনই একজন ব্যক্তিত্ব, তাঁর গাওয়া গানেরা আজও তাঁর মতই জীবন্ত। এভাবেই ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে চির দীপ্তিময় এক অধ্যায় থেকে যাবেন স্বর্ণযুগের অন্যতম গায়ক মহম্মদ রফি।