একটা ছবির সঙ্গে মিলে যায় আরেকটা ছবি। একটা ছবির সূত্রে মনে পড়ে যায় আরেকটা ঘটনা। যেমন আজ সকালবেলা খবরের কাগজে ক্রন্দনরত নীরজ কাউরের ছবি দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ে গেল ২০০৮এ গুজরাট দাঙ্গার সময় এমনই একটা ক্রন্দনরত ছবির সূত্রে সারা দেশে পরিচিত হয়ে ওঠা কুতুবুদ্দিনের কথা। বাবার হত্যাকারীর শাস্তির খবর পাওয়া নীরজের কান্নায় একইসঙ্গে মিশেছিল স্বজন হারানোর যন্ত্রণা ও দোষীদের শাস্তির খবর শোনার প্রতিক্রিয়া। অন্যদিকে কুতুবুদ্দিনের কান্নায় ছিল দাঙ্গাবাজদের কাছে প্রাণ বাঁচানোর আর্তি। ছবি এভাবেই দেশ-কাল মানুষের সীমারেখা পেরিয়ে মানুষকে মিলিয়ে দেয়। কুতুবুদ্দিনের ছবিটা তুলেছিল সরকার বাড়ির দ্য টেলিগ্রাফ কাগজের চিত্রসাংবাদিক অর্ক দত্ত। ঐ বাড়ির নানা প্যাঁচপয়জারের শিকার হয়ে অসম্ভব গুণী এই চিত্রসাংবাদিকটি পরবর্তীকালে যোগ দেয় রয়টার্সে। আমি সেসময় আনন্দবাজারে। ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বও ছিল। সুনামির সময় ওর তোলা একটা বিখ্যাত ছবি ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোতে শ্রেষ্ঠ ছবির স্বীকৃতি পায়। যাকগে সে কথা। সত্যি, সময় কত দ্রুত বদলে যায়।
সময় বদলায়, মানুষ বদলায়, বদলান না শুধু আমাদের দেশের একশ্রেণির রাজনীতিবিদরা। যেমন বদলাননি দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গুজরাট দাঙ্গার সময় সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। সারা দেশ এই ঘটনায় ধিক্কার দিয়েছিল। তার অপরাধে শাস্তির দাবী তুলেছিল মানুষ। এমনকি মোদীর ভুমিকায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত অটলবিহারী বাজপেয়ী। তিনি তাকে রাজধর্ম পালনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বস্তুত তিরস্কার করেছিলেন। মোদীকে সেসময় আমেরিকাও তাদের দেশে ঢোকার অনুমতি দেয়নি। আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী সেই দাঙ্গাধিকৃত মোদী আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু তার স্বভাব বদলায়নি। আমার খুব খারাপ লাগে যখন দেখি সদ্য নির্বাচনী পরাজয়ের যন্ত্রণা ভুলতে তিনি এই রায়ের প্রতিক্রিয়া জানানোর অছিলায় কংগ্রেসের নিন্দায় মুখর হয়ে উঠেছেন। তার কিন্তু এতটা উল্লসিত হওয়ার কোন কারণ নেই। যে রায়কে ঘিরে তাদের উচ্ছ্বাস সেই রায়েই কিন্তু বলা হয়েছে, ১৯৯৩এ মুম্বাইয়ে; ২০০২এ গুজরাটে; ২০০৮এ ওড়িশার স্কন্ধমালে; ২০১৩র উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরে যে দাঙ্গা হয়েছিল তা ছিল রাজ্যে তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ। আমার মনে হয় সজ্জন কুমারদের বিরুদ্ধে আজ যে অভিযোগ মোদীরা আনছেন সেই অভিযোগ তো তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও আনা যায়। আমরা ভুলিনি, ২০০২তে দাঙ্গায় অভিজুক্ত মায়া কোদানির হয়ে সাক্ষ্য দিতে গিয়েছিলেন অমিত শাহ।
আমাদের দেশের দাঙ্গার ইতিহাসের দিকে তাকালে দিল্লি হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের এই মন্তব্যের সত্যতা বোঝা যাবে। দেশভাগের সময় দাঙ্গাও আদতে রাজনৈতিক চক্রান্তের ফসল। তৎকালীন শাসকদের চক্রান্তে যে দাঙ্গা বেঁধেছিল তাতে খুন হয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমান-শিখ সম্প্রদায়ের লক্ষ লক্ষ মানুষ। গোটা দেশের মধ্যে বাঙালিরা এই চক্রান্তের সবচেয়ে বড় শিকার। ধনে-প্রাণে-মানে তাদের ক্ষতি হয়েছিল সব থেকে বেশি। আজও সেই ক্ষতি আমরা সামলে উঠতে পারিনি। তাই রাজনীতির নামে রামরথ, রামমন্দির, গোরক্ষা, অবৈধ অনুপ্রবেশ, এনআরসি ইত্যাদির ধুয়ো তুলে যখন মোদী-অমিত অ্যান্ড কোং দাঙ্গা বাঁধাতে চান তখন বাংলা টানটান সতর্কতায় রুখে দাঁড়ায়। অথচ বারবার বিধ্বস্ত ও পরাজিত হয়েও বিজেপি নামক দলটির দাঙ্গার রাজনীতিতে কোন অরুচি নেই।
সজ্জন কুমারের শাস্তিতে দেশবাসী উল্লসিত হয়েছেন। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর ১৯৮৪সালে ১-৪ নভেম্বর দিল্লিতে যে দাঙ্গা হয়েছিল তাতে কংগ্রেসের ভূমিকা ও দোষীদের আড়াল করার চেষ্টাকে দেশবাসী কোন দিন ক্ষমা করতে পারেনি। তারা বিচার ও শাস্তিদানের প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেছিল এই অভিযোগও সত্যি। আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেছে বহু অভিযুক্ত। কিন্তু রামরথ ও মন্দিরের নামে দাঙ্গা বাঁধানোর নায়ক মোদী-শাহদের এই ব্যাপারে সমালোচনা করার কোন নৈতিক অধিকার আছে বলে আমি মনে করি না। আমার প্রশ্ন ৮৪সালের দাঙ্গার জন্য সজ্জন কুমারের শাস্তি হলে গুজরাট দাঙ্গার সময় রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর কোন শাস্তি হবে না কেন?
দাঙ্গাই এদের রাজনীতি আর রাজনীতি মানেই এদের কাছে দাঙ্গা। এনআরসির নামে আসাম থেকে ৪০লক্ষ বাঙালি বিতাড়ণ করার চেষ্টার মাধ্যমে আরেকটি দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা করা হল। এরা মুসলিম-হিন্দু-অসমিয়া আদিবাসী জনজাতি প্রতিটি সম্প্রদায়কে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। অথচ এরা ভালভাবেই জানেন আসাম চুক্তি অনুযায়ী আসামের ভোটার তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের নাম ন্যাশানাল সিটিজেন রেজিস্টারে নথিভুক্ত করতেই হবে। তাহলে এনআরসির নামে বাঙালিদের তাড়ানোর ধুয়ো তোলা হল কেন? কারণ একটাই, তা হল দাঙ্গা বাঁধানো, বাংলার ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা। এরাই যখন সজ্জন কুমারদের বিরুদ্ধে সরব হন তখন আমার অবাক লাগে।
সজ্জন কুমারের মত অসজ্জন মানুষের শাস্তিতে আমরা আনন্দিত। আমরা জানি দাঙ্গা বাঁধায় রাজনৈতিক দলগুলিই। সাধারণ মানুষ তাদের চক্রান্তের শিকার হন।��� ক্ষমতাসীন দল দাঙ্গায় মদত দিলে মানুষের দুর্দশা আরও বাড়ে। এই দাঙ্গার রাজনীতিকে রাজনৈতিকভাবে উৎপাটিত না করতে পারলে, মতাদর্শগতভাবে এদের পরাস্ত করতে না পারলে বারবার কিন্তু ৮৪-২০০২-২০০৮ ফিরে আসবে। এ ব্যাপারে আপনার আমার মত সাধারণ মানুষদেরও একটা দায়িত্ব আছে। ধর্মীয় বিভেদ উস্কে দেওয়া কোন রাজনীতিকে মানুষ প্রশ্রয় না দিলে রাজনীতিবিদরাও ধর্মীয় তাস ফেলার আগে দু�বার ভাববেন। আমরা যদি বিশ্বাস করি রথযাত্রা আর মহরমের তাজিয়ায় কোন বিরোধ নেই, মন্দির-মসজিদ-গুরুদ্বার-গির্জা সবকিছুর সহাবস্থান একটা স্বাভাবিক সত্য তবে রাজনীতিবিদরাও সে নিয়ে আর বিভেদ সৃষ্টির রাস্তায় হাঁটবেন না। খবরের কাগজে, টিভিতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় দাঙ্গার নতুন নতুন বীভৎসতার ছবি দেখতে দেখতে আমরাও আর বিধ্বস্ত হবো না।
দলমত নির্বিশেষে সবরকম ধর্মান্ধ দাঙ্গাবাজদের উপড়ে ফেলা ছাড়া দাঙ্গা রোখার আর কোন রাস্তা কিন্তু আমাদের কাছে নেই। সজ্জন কুমারের মত মানুষদের প্রতি আমাদের ঘৃণা থাকুক কিন্তু তার থেকেও এই মুহূর্তে বেশি প্রয়োজন হল যে কোন জার্সিধারী বিভেদপন্থীদের রোখার সতর্কতা।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )