আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী এবং কবি শঙ্খ ঘোষের পর এবার জ্ঞানপীঠ উঠতে চলেছে আরও এক বাঙালির হাতে। সাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য এই বছর জ্ঞানপীঠ পুরষ্কার পাচ্ছেন ইংরেজি ভাষার ভারতীয় লেখকদের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী নাম অমিতাভ ঘোষ৷ গতকাল এক বিবৃতি দিয়ে জ্ঞানপীঠ পুরষ্কার কমিটির পক্ষ থেকে এই কথা জানানো হয়, ৫৪ তম জ্ঞানপীঠ পুরষ্কারের জন্য অমিতাভ ঘোষের নাম বিবেচিত হল।
ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘অমিতাভ ঘোষ প্রকৃত অর্থেই একজন মহান লেখক। নিজের উপন্যাসের মধ্য দিয়ে নতুন অভিমুখ তৈরি করেছেন তিনি। তাঁর লেখায় বরাবরই যেমন প্রাঞ্জলভাবে উঠে আসে ইতিহাস, ঠিক একইরকমভাবে চলে আসে আধুনিকতাও। ইতিহাস ও আধুনিকতার মেলবন্ধনটি হয় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে। তাঁর সাহিত্যে ইতিহাস ও সামাজিক নৃতত্ব গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে।’ জ্ঞানপীঠ পুরষ্কারের নির্বাচন কমিটির প্রধান হলেন আরেক বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জ্ঞানপীঠ পুরষ্কার প্রাপ্ত প্রতিভা রায়। তিনিও এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘অমিতাভ ঘোষ একজন ছকভাঙা উপন্যাসিক।’
কিন্তু এই সম্মান নিয়ে কী ভাবছেন লেখক স্বয়ং? এই বিষয়ে ‘দ্য হাংরি টাইড’-এর লেখকের প্রথম টুইটটি সংক্ষিপ্ততর, ‘আমি সম্মানিত।’ পরে আরেকটি টুইটে তিনি বলেন, ‘ধন্যবাদ। আমার জীবনের অন্যতম একটি আনন্দদায়ক দিন এটি। আমি কোনওদিন ভাবিনি, যে লেখকদের আমি অনুসরণ করতাম, তাঁদের সঙ্গে এক তালিকায় আসতে পারব।’ প্রসঙ্গত, দেশের এই শীর্ষ সাহিত্য সম্মান পাওয়ার আগে, ২০০৯ সালে ‘ দ্য শ্যাডো লাইন্স’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরষ্কার পেয়েছেন অমিতাভ। ২০০৭-য়ে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। এছাড়া ‘স্য সি অফ পপিস’-এর জন্য ২০০৮ সালে ম্যান বুকারের জন্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
১৯৫৬ সালের ১১ জুলাই কলকাতায় জন্ম তাঁর। ৬২ বছর বয়সী এই লেখক এখন থাকেন নিউ ইয়র্কে। বেড়ে ওঠা কলকাতায় এবং বাংলাদেশ এবং কিছু সময়ে শ্রীলঙ্কায়। পড়াশোনার পাঠ শুরু হয় কুলীন দুন স্কুল থেকে। সেখান থেকে দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ, দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স হয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানকার সেন্ট এডমান্ড হল থেকে নৃতত্ত্বে ডি ফিল করেন তিনি। অমিতাভ এখন বেশিরভাগ সময়েই থাকেন নিউ ইয়র্কে। মাঝেমাঝে গোয়ায়।
শৈশব থেকেই সমুদ্রের প্রতি তীব্র টান ছিল তাঁর। ভাল লাগত জলদস্যুদের রোমহর্ষক, জমজমাট সব গল্প। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার মতো উপকূলবর্তী অঞ্চলে বেড়ে ওঠায় নদ-নদী, সমুদ্রের প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য। ছেলেবেলায় শোনা চাঁদ সওদাগরের কিসসা চমৎকৃত করেছিল তাঁকে। অবাক করেছিল ‘মবি ডিক’-ও। লেখক অমিতাভ ঘোষের গল্পের জালবোনা তাই কখনও সুন্দরবন, কখনও ইরাওয়াডি নদী কখনও বা বৃহত ভারতীয় মহাসাগরকে পটভূমিকা করে। জলকে চরিত্র করে পরতে পরতে প্রাণ পেয়েছে ‘দ্য হাংরি টাইড’, ‘দ্য গ্লাস প্যালেস’, ‘ফ্লাড অফ ফায়ার’। প্রায় প্রত্যেকটি লেখাতেই জলের উপস্থিতি জলছাপ রেখে যায় পাঠকের মনে।
মূলত ইংরেজি ভাষাতেই আজীবন সাহিত্য রচনা করেছেন অমিতাভ। লিখেছেন ফিকশন ও নন-ফিকশন, সব ধরনের লেখাই। প্রথম উপন্যাস ‘দ্য সার্কেল অফ রিসন’ প্রকাশ হয় ১৯৮৬-তে। তারপর একে একে ‘দ্য শ্যাডো লাইন্স’ (১৯৮৯), ‘দ্য ক্যালকাটা ক্রোমোজোমস’ (১৯৯৫), ‘দ্য গ্লাস প্যালেস’ (২০০০), (যার সুবাদে এসেছে কমনওয়েলথ রাইটার্স প্রাইজ), ‘দ্য হাংরি টাইড’ (২০০৪), ‘দ্য সি অফ পপিজ’ (২০০৮)–র মতো জনপ্রিয় উপন্যাসগুলি তাঁকে সমসাময়িক ইংরেজি সাহিত্যিকদের সেরাদের তালিকায় পৌঁছে দেয়। আফিম যুদ্ধের ঠিক আগে ১৮৩০-এর প্রেক্ষাপটে অমিতাভের ‘দি ইবিস ট্রিলজি’ ঔপনিবেশিক ইতিহাসের দলিল যেন। এখনও পর্যন্ত তাঁর শেষতম উপন্যাসটির নাম- ‘দ্য গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্টঃ ক্লাইম্যাট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য আনথিঙ্কেবল, আ ওয়ার্ক অব নন-ফিকশন’। যা প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে।