সে এক সময় ছিল। ঠাকুমা-দিদিমা’রা শীতের দুপুরে ছাদে বসে কাঁটা-কুরুশ, উল দিয়ে তৈরি করতেন দারুণ দারুণ সব শীতবস্ত্র। সারাদিনের কাজের পরে দুপুরবেলার ওই বিশ্রামের সময়টুকুতে গল্প করতে করতে বানিয়ে ফেলতেন রংবাহারি সোয়েটার, টুপি, হাতমোজা বা আধুনিক পরিভাষায় গ্লাভস, মাফলার ইত্যাদি নানা ধরণের শীতে ব্যবহৃত পোশাক।
নানা ধরণের নকশাতে তাঁরা তৈরি করতেন এই সমস্ত শীতপোশাক। প্রতিটির ডিজাইন অন্যটির থেকে আলাদা। সোয়েটারের গা এবং হাতা সাধারণত কাঁটা দিয়ে বোনা হত, তার ওপরে বসানো ফুলগুলি হত কুরুশ দিয়ে।
শুধু সোয়েটারই নয়, উল দিয়ে তৈরি করা হত দুই-তিন ধাপের পা অবধি লম্বা উলের ফ্রকও। এক একটা ধাপে একেক রকমের নকশা!
উল দিয়ে তৈরি হত পায়েরও মোজা। আগেকার দিনে কেউই বাইরে থেকে কেনা শীতবস্ত্র পড়ত না তখন যদিও বাড়িতে বানানো পোশাকেরই চল ছিল। বাচ্চাদেরকে টুপি-সোয়েটার–হাত এবং পা মোজা ইত্যাদি উপহার দেওয়ার চল ছিল। এমনকি বাচ্চারা বড় হয়ে যাওয়ার পরও সেই জিনিস গুলিকে যত্ন করে তুলে রাখা হত প্রায় সব বাড়িতেই।
তারপর দিন বদলাল। পরিবর্তন হল সময়েরও। কালের নিয়মেই সেই সব মানুষেরা চলে যেতে লাগলেন। কাঁটা-কুরুশ স্থান পেল আলমারির কোণে। পরিবর্তন এল মানুষের রুচি-পছন্দ এবং কেনাকাটার বাজারেও। তৈরি হতে লাগল নানা নতুন শীত বস্ত্র প্রস্তুতকারক সংস্থা। তাদের তৈরি শীতের পোশাক বিক্রি হতে লাগল দোকানে-দোকানে। ক্রেতারাও খুশি মনেই কিনতে লাগলেন। কারণ হাতে বানিয়ে দেওয়ার মত মানুষ আর নেই…
বাজারে ছেয়ে গেল সিনথেটিক উলের সোয়েটার, চামড়ার জ্যাকেট, গ্লাভস, ব্র্যান্ডেড টুপিতে। বর্তমানে যে ‘উলেন কুর্তি’ খুব জনপ্রিয়, তা কিন্তু আগেকার দিনের সেই উলের ফ্রকের থেকেই এসেছে। আগেকার উলের পঞ্চুই এখনকার সিল্কের মেটেরিয়ালে বা সুতোর কাজে পাওয়া যায়। তবে আর পাওয়া যায় না সেই নানা রকমের ফুল বসানো সোয়েটার। এখনকার সোয়েটারেও বিভিন্ন ডিজাইন পাওয়া গেলেও তা মূলত একই ধাঁচের হয়।
সময়ের সঙ্গে আরও বদলে যাবে সব কিছুই। বদল আসবে শীত পোশাকের পশরাতেও। আসবে আরও নানা ধরণের নতুন নতুন শীত বস্ত্র। আমরা সেসব কিনবও। তবে এই ভাবে একইসঙ্গে হারিয়ে যেতে থাকবে হাতে বোনা শীত পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আন্তরিকতা। হারিয়ে যেতে থাকবে উল-কাঁটা বোনার সেই মুহূর্তগুলো।