দৃশ্য এক: গতকাল ট্রেনে হাওড়া থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। আমি এক জানলার ধারে বসে, অপর দিকের জানালার ধারে এক দম্পতি তাদের পাঁচ- ছয় বছরের এক বাচ্চাকে নিয়ে বসে। বাচ্চাটা অনবরত তার বাবা-মাকে বিভিন্ন জিনিস দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছে এটা কি ওটা কি। কিন্তু তারা ব্যাস্ত, কিসে না মোবাইল ফোনে। আর মাঝেমধ্যে বাচ্চাটাকে ধমক দিয়ে উঠে বলছে চুপ বস্, বিরক্ত করিস না ইত্যাদি। তখন বেলুড় স্টেশন ঢুকছে। বাচ্চাটা স্টেশনের নাম পড়ে এবং তা ইংরেজিতে, বানান করে। হঠাৎ উল্টো দিকের এক লোক বলে বাচ্চাটাকে বাংলায় কি লেখা আছে বলতে। চটপটে মায়ের চটপটে উত্তর ওতো বাংলা পড়তে পারে না। ইংরেজি স্কুলে পড়ে ওখানে ইংরেজিই সব, বাংলা পড়ানো হয় না। পরের স্টেশন চলে আসায় উল্টো দিকের কথাবার্তা আর ঠিক মতো শুনতে পাইনা। কিন্তু হঠাৎ একটা কথায় কান ঝালাপালা হয়ে উঠল। শুনতে পেলাম বাচ্চাটার বাবা বলছে বাংলা পড়ে কিবা হবে ও ওটা বলতে পারলেই হলো। এখন তো হিন্দি ইংরেজির যুগ ওগুলো শিখলেই হল। এরপর আর কোনো কথা শুনতে পাইনি ভীড় হয়ে যাওয়ায়।
দৃশ্য দুই: এটা বেশ কিছু দিন আগের ঘটনা। আমি এক জায়গায় কোচিং এ যাই। সেখানে এক টিচার আসে ক্লাস নিতে। স্বাস্থ্যবান শরীর আর কপালে লাল টিকা। এক পলকে দেখলে মনে হবে পাক্কা পান-গুট্টাখোর হিন্দুস্তানি। দেখে প্রথমটা তে আমার তেমন শ্রদ্ধা জাগেনি। কিন্তু ক্রমে পড়ানো ও অন্যান্য কাজকর্মে আমার তার উপর একটু শ্রদ্ধা জাগে। তারপর ভাবি পড়তে এসেছি যখন তখন এসব দেখে লাভ নেই। এর কিছু পর একটা কথা আমার চটকা ভেঙে দিল। ক্লাসের একেবারে শেষের দিকে হঠাৎ ঐ শিক্ষক বলে বুঝতে না পারলে জিজ্ঞাস করতে (স্বভাবতই সমস্ত ক্লাসটা হিন্দিতেই হয়)। এরপর এক ছাত্র বলে উঠে ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে “সামাজ আয়া”। এই কথাতে কিন্তু কেউ হাসে না। এরপর ঐ শিক্ষক আরও এক কথা বলে যা মাথা গরম করার পক্ষে যথেষ্ট। “ইউপি-বিহার-দিল্লীতে পড়াতে গেলে হিন্দিতেই পড়াতে হবে। ওদের অন্য কোনো ভাষায় পড়ানোই যাবে না। কিন্তু ‘বংগাল’এ ব্যাপারটা আলাদা। এখানে হিন্দি ইংরাজিতে লোকে বেশি সাবলীল। এরা বাংলা বলতে বেশ লজ্জা পায়”। কোটেশনের পুরোটাই উনি হিন্দিতে বলেন, আমি তার বাংলা তর্জমা করলাম শুধু। শেষ কথাটায় হাসির রোল উঠল কি, সে এক দেখার মতো। সাথে সাথেই ঐ শিক্ষক ও ভাঙাভাঙা বাংলাতে বলে ওঠে “কি, ঠিক বললাম তো”। এবার আগের থেকেও জোর ছিল হাসির।
দৃশ্য তিন: এক গাড়িতে চারজন কলকাতা Airport থেকে রাজারহাট নিউটাউনে ফিরছে। সময় রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা হবে। গাড়িতে আছে এক দম্পতি, তাদের আট-নয় বছরের ছেলে আর এক জৈনক ব্যক্তি যার বয়স আনুমানিক কুড়ি থেকে পঁচিশ হবে। তাদের মধ্যে কথপোকথন নিম্নরূপ।
জৈনক ব্যক্তি: তোমার নাম কি?
ছেলে: অ্যারিয়্যান গ্যাংগুলি ( সহজে আরিয়ান গাঙ্গুলি)।
জৈনক ব্যক্তি: তুমি কোন ক্লাসে পড়?
আরিয়ান: ক্লাস ও’য়ান (আদতে উচ্চারণ করল ভাওন)।
জৈনক ব্যক্তি: কোন স্কুল?
আরিয়ান: দিল্লী পাবলিক স্কুল।
জৈনক ব্যক্তি: কোথায় এই স্কুলটা?
আরিয়ান: আরে বোলা না দিল্লী পাবলিক স্কুল।
পাস থেকে মা বলছে
মা: হোয়ার পুচছে, বল্।
আরিয়ান: ওহহ, সরি। I don’t understand your word. উটা নিউটাউনে।
জৈনক ব্যক্তি: আচ্ছা।
জৈনক ব্যক্তিটি দেখল এদের সাথে কথা বলে সুখ নেই। তাই চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করে চুপ থাকে আর বাইরের দৃশ্য দেখে। রাতের কলকাতা। এর সৌন্দর্য ও গায়ে মেখে তা অনুভব করতে থাকে। হঠাৎ নিঃশব্দতা ভাঙে আরিয়ানের মা। হয়ত এই নিঃশব্দতা তাকে ধন্দে ফেলেছিল তাই। ভাঙা বাংলাতে বলে
মা: আসলে ওদের তো তেমন বাংলা বলে না তাই বাংলা বুঝে না।
জৈনক ব্যক্তি: কেন? আপনি তো বাঙালি। বাংলা তো আপনার মাতৃভাষা। তো ছেলেকে বাংলা শেখাচ্ছেন না কেন?
মা: আসলে আমি বাংলা বলতে বা বুঝতে পারলেও পড়তে জানি না। ধানবাদে জন্ম তাই বাংলাটা তেমন ভাবে শেখা হয়নি। আর ও তো বাংলা একেবারেই বলতে পারেনা। বাংলার বাইরে থাকলে যা হয় আরকি।
এরই মধ্যে ওনার (বাবা) মোবাইল বেজে ওঠে। ফোনের গান আবার একটা হিন্দি ইংরেজির মিশ্রিত গান। যা কথা হল সবই ইংরেজিতে। এরপরেই মা আমাকে বলে
মা: বাইরে থাকার ফলে।
(জৈনক ব্যক্তি বাদে সবার কথাতে হিন্দির টান স্পষ্ট)
বলেই এক অবজ্ঞাসূচক হাসি হাসে। জৈনক ব্যক্তিটি নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এখানে ওর নিজেকে খুব বোকা মনে হয়। ইতিমধ্যে কলকাতা গেটের সিগন্যালে গাড়ি এসে দাঁড়ায়। আর মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ব্যক্তিটি তার বাড়ি চলে আসবে। এই ভেবেই তার আনন্দ হয়। মনে মনে ভাবে এটাই হয়তো আচ্ছে দিন। নিজেকে পরিবর্তন করতে না পারলে হয়ত এই মিষ্টি বাংলাভাষার মতন তারও একই পরিণতি হবে। সবাই বলবে এ তো পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়।
**উপরের ঘটনাটি সত্য হলেও চরিত্রগুলো আদতে কাল্পনিক।
দৃশ্য চার: হাওড়া স্টেশন। বড় ডিসপ্লে বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কোন্ প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দেবে দেখার জন্য। হাতে কিছু খাবার ছিল। হঠাৎ এক উটক লোক এসে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে যায়। আমি ভাবি তাড়া আছে ট্রেন ধরবে তাই কিছু বলি না। আবার কিছু মুহূর্ত পর দেখি ওই একই লোক আবার ধাক্কা মারে, এবার আগের থেকে জোরে। আচমকা ধাক্কাতে হাত থেকে সেই খাবারটা পড়ে যায়। আমি দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরি আর বলি এটা কি পরপর দুবার ধাক্কা মারলে কেন। বলাতেই সে রেগে উঠে। হিন্দি-ভজপুরি মেশানো ভাষায় কি সব বলে গেল। শেষে পরিস্কার বাংলায় বলল বাঙালি বাঙালির মতো থাকবি। উপরে উঠতে চাইলে মেরে খোঁড়া করে দেব। বলেই দৌড়। আমি আকষ্মিক এই জবাবে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
উক্ত ঘটনার মতো অনেক ঘটনা আমাদের চোখের সামনে ঘটছে। আর আমারা তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুপ করে দেখছি। বাঙালি সময় থাকতে জাগো নয়ত অনেক দেরি হয়ে যাবে। এর দায়িত্ব সবাইকেই নিতে হবে। ছোটো ছোটো বাচ্চাদের বাংলা শেখান (প্রফেশনাল জীবনের জন্য ইংরেজি হিন্দি গুরুত্বপূর্ণ, পাশাপাশি এগুলো শেখালে দোষ নেই)। বাংলায় কথা বলুন আর সর্বোপরি বাংলাকে অবজ্ঞা না করে কাছে টেনে নিন দেখবেন আবার আমরা বাংলাকে নিয়ে গর্ব করতে পারব। আবার আমরা অন্যদের পথপ্রদর্শক হতে পারব, কেউ আটকাতে পারবে না।
সর্বশেষ একটাই কথা বলব বাংলায় কথা বলুন, বাংলায় ভাবুন, আর বাংলাভাষাকে শ্রদ্ধা করুন।