বৃত্ত সম্পূর্ণ হতে বাকি রইল মাত্র আর এক ধাপ। তবে ইতিমধ্যেই মেক্সিকোর পিকো দ্য ওরিজাবা জয় করে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নিজের নাম তোলার পথের প্রায় শেষ প্রান্তে পোঁছে গেলেন কলকাতার বাসিন্দা সত্যরূপ সিদ্ধান্ত। বিশ্বের কনিষ্ঠতম পর্বতারোহী হিসাবে সাত মহাদেশের সাত সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয়ের মুকুট পরার জন্য তাঁর বাকি রইল শুধু মাত্র দক্ষিণ মেরুর উচ্চতম আগ্নেয়গিরি মাউন্ট সিডলি জয়।
বুধবার ভারতীয় সময় রাত ২টোয় পিকো দ্য ওরিজাবা ছুঁয়ে ফেলেন সত্যরূপ। তবে মোটেও সহজ ছিল না এই পথটা। উত্তর আমেরিকার সর্বোচ্চ আগ্নেয়গিরি শৃঙ্গ এই পিকো দ্য ওরিজাবা। যার উচ্চতা ৫ হাজার ৬৩৬ মিটার। যার শেষ ২০০ মিটার ছিল ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’। কিন্তু পাহাড় যার আজীবনের ভালবাস তাঁকে আটকাবে এমন সাধ্য কার? কার্যত প্রাণ হাতে করে ওই দূরত্ব পেরোনোর পর জয়ের তৃপ্তি ঢেকে দিয়েছিল অপরিসীম কষ্টকে এমনটাই জানিয়েছেন তিনি। তবে আগ্নেয়গিরির ছিটকে আসা পাথর লেগে জখম হয়েছেন সত্যরূপ এখন হাসপাতালে ভর্তি। আঘাত অবশ্য তেমন গুরুতর নয় বলেই হাসপাতাল সূত্রে খবর। সত্যরূপের সঙ্গী সালভাদোর অবশ্য পড়ে গিয়ে গুরুতর জখম হয়েছেন। তাঁর উরুর হাড় ভেঙেছে।
সত্যরূপ জানিয়েছেন এই শৃঙ্গ জয়ের পরে শেষ লক্ষ্য অর্থাৎ মাউন্ট সিডলির উদ্দেশে আগামী বছর জানুয়ারী মাসেই রওনা দেবেন। এই অন্তিম পর্বে তিনি সফল হলে ৩৫ বছর ২৫৮ দিনের মাথায় সাতটি মহাদেশের সর্বোচ্চ এবং সর্বোচ্চ আগ্নেয়গিরি শৃঙ্গ জয় করবেন। যা সবথেকে কম বয়সে করা, এই সাফল্যের নতুন বিশ্বরেকর্ড হবে। উল্লেখ্য, এর আগে সবথেকে কম বয়সে সাতটি মহাদেশের সর্বোচ্চ এবং সর্বোচ্চ আগ্নেয়গিরি শৃঙ্গ জয় করার রেকর্ড করেছেন অস্ট্রেলিয়ার ড্যানিয়েল বুল। তিনি ৩৬ বছর ১৫৭ দিনের মাথায় ওই বিশ্ব রেকর্ড করেছিলেন।
সাতটি মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের মধ্যে থাকা আফ্রিকার মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো এবং ইউরোপের মাউন্ট এলব্রুস আবার সাতটি মহাদেশের সর্বোচ্চ আগ্নেয়গিরি শৃঙ্গ হিসেবেই স্বীকৃত। সেক্ষেত্রে কিলিমাঞ্জারো এবং এলব্রুস শৃঙ্গ আগেই জয় করা হয়ে গিয়েছিল সত্যরূপের। পরে এশিয়ার সর্বোচ্চ আগ্নেয়গিরি শৃঙ্গ ইরানের মাউন্ট দামাবন্দ, দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ আগ্নেয়গিরি শৃঙ্গ আর্জেন্টিনার-চিলি সীমান্তে অবস্থিত ওজোস দেল সালাদো এবং ওশিয়ানিয়ার পাপুয়া নিউ গিনিতে অবস্থিত সর্বোচ্চ আগ্নেয়গিরি শৃঙ্গ মাউন্ট গিলাউয়ি জয় করেন তিনি। এবার উত্তর আমেরিকার সর্বোচ্চ আগ্নেয়গিরি শৃঙ্গ পিকো দ্য ওরিজাবা জয় করলেন।
ছেলে যখন শৃঙ্গ জয় করতে দুর্গম পথে যাত্রা করছেন, সেই সময়ে প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরে, কলকাতায় মা গায়ত্রী সিদ্ধান্তও দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি দুশ্চিন্তা ও উত্তেজনায়। দু’টো প্রশ্ন সর্বক্ষণ তাড়া করছিল তাঁকে। ছেলে পারবে তো? ওর কোনও বিপদ হবে না তো? সেই দুশ্চিন্তা শেষ হল ছেলের জয়ের খবর পাওয়ার পর। বৃহস্পতিবার সকালে তিনি বলেন, ‘খুব ভয় করছিল। একটা অজানা আতঙ্ক চেপে ধরেছিল। সারা রাত ঘুমোতে পারিনি।’ মা যখন দুশ্চিন্তায় বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছেন, ছেলে সেই সময়ে একটু একটু করে আলগা ও ঝুরো পাথর আর আগ্নেয়গিরির ছাই পেরিয়ে এগোচ্ছেন চূড়ার দিকে। সত্যরূপ টুইট করে বলেন, ‘শেষ ২০০ মিটার ছিল ভয়াবহ। একটু এদিক-ওদিক হলেই সব শেষ।’ শেষমেশ পাহাড়ের চূড়ায় পা রেখে সমস্ত পরিশ্রম সার্থক হল বলে মনে করছেন সত্যরূপ।
পিকো দ্য ওরিজাবার দিকে এগোনোর আগে সেখানকার অবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে ১ ও ২ ডিসেম্বর আশপাশের আরও দু’টি শৃঙ্গে ওঠেন সত্যরূপ। তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন স্থানীয় পর্বতারোহী সালভাদোরকে। সত্যরূপ জানাচ্ছেন, এই আগ্নেয়গিরির একাধিক স্তর, তাই এর উপর দিয়ে এগোনো বেশ কঠিন ছিল। শৃঙ্গ জয় করার পর বড়সড় দুর্ঘটনার হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পান সত্যরূপ। তাঁর বন্ধু দীপাঞ্জন দাস জানিয়েছেন, ভোররাতে পিকো দ্য ওরিজাবা জয়ের পর সত্যরূপ এবং তাঁর গাইড সালভাদোর নীচে নামছিলেন। ভারতীয় সময় এদিন ভোর প্রায় সাড়ে চারটে নাগাদ আচমকাই একটি পাথর তাঁদের দিকে গড়িয়ে আসে। আহত হয়েও ওই অবস্থাতেই তাঁরা বেসক্যাম্পে ফিরে আসেন। সেখান থেকে দু’জনকেই স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অবশ্য প্রাথমিক চিকিৎসার পর রাতেই সত্যরূপকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
পাহাড়ে চড়তে গেলে বিপদ লুকিয়ে ধাপে ধাপে। সেসব অতিক্রান্ত করে এত কম বয়সে এত সাফল্য পেয়েছেন সত্যরূপ। এবার নিজেকে তৈরি করছেন শেষ লক্ষ্য অ্যান্টার্কটিকার মাউন্ট সিডলি অতিক্রম করে সেই বিরল সাফল্যের অধিকারী হওয়ার জন্য।