বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে, যে সকল তরুণ বিপ্লবী নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম দীনেশ গুপ্ত। আজ এই মহান বিপ্লবীর ১০৮তম জন্মদিবস।
১৯১১ সালে এই আজকের দিনেই তৎকালীন ঢাকা জেলার (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলা) যশোলঙে বিপ্লবী জন্মগ্রহণ করেন এই তরুণ বিপ্লবী। তাঁর বাবা ছিলেন সতীশচন্দ্র গুপ্ত। এবং মা বিনোদিনী দেবী। ছোটবেলায় দীনেশ গুপ্তের ডাকনাম ছিল নসু। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান। বাবার বদলির চাকরির সূত্রে একসময় তাঁরা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। এবং ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন।
ছোটবেলা থেকেই দীনেশ ছিলেন নির্ভীক ও দুরন্ত প্রকৃতির। ১০ম শ্রেণীতে পড়াশোনাকালীন তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স (বিভি) নামে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের সংস্পর্শে আসেন। ১৯২৬ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে (ঢাকা বোর্ড) ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯২৮ সালে তিনি মেদিনীপুরে চলে আসেন এবং মেদিনীপুর কলেজে ভর্তি হন। সেখানকার বিপ্লবী দলের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হলে পড়াশোনার পাশাপাশি বিপ্লবী দলের সদস্য সংগ্রহের কাজও চালিয়ে যেতে থাকেন।
এরপর সুভাষ চন্দ্র বসু ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’কে অ্যাকশনধর্মী বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলেন। শুরু হয় বিপ্লবীদের আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ। সেই সময়ে দীনেশও বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ দিতেন। একপর্যায়ে সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে এই সংগঠনের বিপ্লবীরা কুখ্যাত ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারদের হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। আর এই অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় দীনেশ-সহ বিনয় বসু ও বাদল গুপ্তের ওপর।
৮ ডিসেম্বর (১৯৩০) বেলা ১২টায় রাইটার্স বিল্ডিং যখন কর্মমুখর তখন সামরিক পোশাকে বিনয়, বাদল ও দীনেশ সেখানে প্রবেশ করেন। তারপর পুলিশের কারা বিভাগের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা কর্ণেল সিম্পসন সাহেবের কক্ষে ঢুকে তিন জনেই গুলি চালান। গুলিতে সিম্পসন সাহেবের প্রাণহীন দেহ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর বিনয়-বাদল-দীনেশের গুলিতে নেলসন ও টয়নয় নামক উচ্চ পদস্থ ইংরেজ কর্মকর্তা আহত হন ও অন্যান্যরা গুলির মুখে পালিয়ে যান। কিন্তু এরপরই বিশাল সশস্ত্র বাহিনী রাইটার্স ভবন ঘেরাও করে।
এরপর সশস্ত্র এবং প্রশিক্ষিত গুর্খা বাহিনীর আক্রমণের সামনে শুধু রিভলভার হাতে যুদ্ধরত তিন বিপ্লবী। যা ইতিহাসের পাতায় ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামেই খ্যাত। এক সময় তাদের গুলি ফুরিয়ে যায় এবং দীনেশ গুলিবিদ্ধ হন। পরাজিত হয়ে বৃটিশদের হাতে ধরা পড়ার বদলে তারা মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করলেন। তাই প্রত্যেকেই মারাত্মক বিষ পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে নিলেন এবং মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যেকে তাদের শেষ গুলিটি নিজেদের মাথায় বিদ্ধ করলেন। বাদল তৎক্ষণাৎ মৃত্যু বরণ করলেও ভীষণভাবে আহত মুমূর্ষু অবস্থায় দীনেশ ও বিনয় ধরা পড়েন।
উভয়কেই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে, সেখানেও তাদের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালানো হয়। অত্যাচার এড়াতে বিনয় মাথার ব্যান্ডেজের ভেতর দিয়ে মগজে আঙুল ঢুকিয়ে মৃত্যুকে বরণ করেন। অন্যদিকে ডাক্তার-নার্সদের অক্লান্ত সেবায় সুস্থ হয়ে ওঠা দীনেশের উপর চলতে থাকে নির্যাতন। পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে বিচারের নামে শুরু হয় প্রহসন। শেষমেষ ইংরেজ সরকার দীনেশকে ফাঁসির শাস্তি শোনায়।
১৯৩১ সালের ৭ জুলাই, আসে সেই চরম ক্ষণ। মাত্র ১৯ বছরের এক তরতাজা তরুণ প্রাণ জীবনকে বিদায় জানাতে নির্ভীক চিত্তে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন। নিজের হাতেই ফাঁসির দড়ি মালার মতো গলায় দিলেন। কর্মরত কারা কর্তৃপক্ষ এসময় তাঁর কাছে জানতে চান ‘তুমি কি কিছু বলতে চাও? উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের বলার অধিকার কারা কেড়ে নিয়েছে, তা তোমরাই ভাল জান। তাই ডু ইওর ডিউটি’। এরপরই তরুণের হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত স্বাধীনতার মন্ত্র ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনির অনুরণন আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে একটি অবিনাশী জীবনের দীপশিখা নিভে গেল।