কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের সাফল্যে ঈর্ষায় ভোগা কিছু মানুষ তেমন কোন খুঁত খুঁজে না পেয়ে শেষমেশ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গালমন্দ করতে শুরু করেছেন। তারা অভিযোগ তুলেছেন, নন্দন চত্বরে মুখ্যমন্ত্রীর এত ছবি কেন? এই প্রশ্নের সত্যি কোন উত্তর হয় না। কারণ, ছবি বা কাট আউটগুলো মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে বা তার নির্দেশে লাগানো হয়নি। যারা উৎসব প্রাঙ্গন সাজানোর দায়িত্বে ছিলেন তারা স্বাধীনভাবে কাজ করেন, তারা যেটা সঠিক মনে করেছেন সেটাই করেছেন। এটা দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন, একজনের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আরেকজনের দৃষ্টিভঙ্গি নাও মিলতে পারে। সমালোচকরা ভুলে গেছেন ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি বাংলায় এখন আর নেই।
আমার প্রশ্ন, চলচ্চিত্র উৎসব প্রাঙ্গণে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কয়েকটা ছবি বেশি থাকলে আপনাদের অসুবিধাটা ঠিক কোন জায়গায় হচ্ছে? এই উৎসবের ছবিটাই তো তিনি ক্ষমতায় আসার পর একেবারে বদলে গেছে। একদা তার সমালোচনায় মুখর বিখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বরাও একথা স্বীকার করছেন। তারাও এখন এই উৎসবের আয়োজনের সহায়ক ও পরামর্শদাতা। আমার মনে হয় কাঁধে ঝোলা, মুখে একগাল দাড়ি, হাতে মলিন পেপারব্যাক নিয়ে উৎসব প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে যারা কথায় কথায় আমজনতাকে তুচ্ছ করে নিজেদের বুদ্ধির দৌড় প্রমাণ করতে চাইতেন তারা ছাড়া এতে আর কারোর অসুবিধা হচ্ছে না।
ফিল্মোৎসবকে আমাদের দিদি মানুষের উৎসবে পরিণত করেছেন এতেই তাদের আপত্তি। শুধুই কয়েকজন বিদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতার মধ্যে আটকে না থেকে বাংলার ছবি, ভারতের ছবি, অন্যধারার ছবি এই উৎসবে এখন গুরুত্ব পাচ্ছে। দেশের ঠাকুরকে ফেলে বিদেশের কুকুরকে ভজনা করা তথাকথিত বঙ্গীয় সিনে পণ্ডিতদের এটা ভীষণ গায়ে লাগছে। বাংলা ছবি নিয়ে রাজ্য সরকারের উদ্যোগ বলিউডের তারকা থেকে শুরু করে সেই ইন্ডাস্ট্রির কর্ণধাররাও স্বীকার করছেন। প্রতি বছর সেখানকার নামী তারকা ও পরিচালকদের এখানে আসা তারই স্বীকৃতি। নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থেই এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছেন তারা। কারণ, বাংলা বলিউডের ছবির একটা বড় বাজার। এতে বাংলার চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত সব মানুষেরই উপকার হবে।
একজন পেশাদার হিসেবেই আমি জানি পৃথিবীর বেশিরভাগ রাস্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, নেতাদের যে ছবি সরকারি বিজ্ঞাপন, প্রেস রিলিজ ইত্যাদিতে আপনারা দেখেন তার অধিকাংশই রীতিমত কাঠখড় পুড়িয়ে তোলা হাই রেজলিউশনের ছবি। এতে ব্যয়ও কম নয়। মোদীর সহাস্য মুখের যে ছবিটি এখন কেন্দ্রীয় সরকারের নানা বিজ্ঞাপনে গোটা দেশের মানুষ দেখেন সেটাও কিন্তু এমনই একটা ছবি। গত কয়েকবছর ধরে দেশের প্রধানমন্ত্রী, গঙ্গাদূষণ রোধ থেকে নতুন সড়ক বা সেতু নির্মাণ, আর্থিক সংস্কার থেকে প্রতিরক্ষা, বিজ্ঞান থেকে পর্যটন প্রতিটি সরকারি উদ্যোগ বা যোজনার প্রচারে যেভাবে নিজের ছবি তুলে ধরছেন সেটা নিয়ে কিন্তু এরা একটা কথাও বলেননি। এমনকি উপরের উদ্যোগগুলির ব্যর্থতা বা ত্রুটি নিয়েও মুখ খোলেননি তারা। সামান্য ছবি তোলার সূত্রে আমি জানি দামী পোশাক পরে প্রবল ব্যক্তিত্বময় ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ছবিগুলো তুলতে কী পরিমাণ ব্যয় হয়েছে! কত সময়, আলো, সম্পাদনা প্রয়োজন হয়েছে!
কয়েকটা বেশি ছবির জন্য সমালোচনার শিকার হওয়া আমাদের মুখ্যমন্ত্রী এমন ছবি কখনও তোলেন না। বহুবার কোন কাজের জন্য এমন ছবি তোলার কথা তাকে বলতে গিয়ে রীতিমত ধমক খেয়েছি। স্পষ্ট বলে দিয়েছেন এমন পোজ দিয়ে ছবি আমি তুলতে পারবো না। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে নানা অভিযোগ ছুঁড়ে দেওয়া সংবাদমাধ্যমগুলির সাংবাদিক বা আলোকচিত্রীরা কেউই বলতে পারবেন না যে দিদি সাংবাদিকদের ডেকে বা তাদের অনুরোধে ছবি তোলার জন্য কোন পোজ দিয়েছেন। চলচ্চিত্র প্রেম নয়, এর আড়ালে আছে বাংলাকে ছোট করার, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে ছোট করার এক নির্ভেজাল রাজনীতি। নন্দন চত্বরে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি বেশি লাগানো হয়েছে এটা বলে যারা বাজার গরম করতে চাইছেন তারা কিন্তু বাংলার ভালমন্দ নিয়ে কোন ব্যাপারে মুখ খোলেন না। যে সাম্প্রদায়িক শক্তি রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে রথ বার করে অশান্তি বাঁধাতে চাইছেন সে ব্যাপারে এরা একেবারেই নীরব।
চলচ্চিত্র উৎসবকে কেন্দ্র করে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নিজের পাবলিসিটি করছেন, এই অভিযোগ একেবারেই অবান্তর। ক্ষমতায় আসার অনেক আগে থেকেই রাজ্যের মানুষের স্বার্থে নিজের জীবনকে বাজি রাখা লড়াইয়ের সুবাদে তিনি বাংলা ও ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও পরিচিত। আমাদের দিদি রাজনীতির মানুষ, রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের সেবা করাটাই তার আদর্শ। এটাই তার একমাত্র পরিচিতি। তার কোন বুদ্ধিজীবী তকমার দরকার হয়না। তার বিরুদ্ধে বিরোধীরা নানারকম অভিযোগ করেছেন, কিন্তু নিজেকে একজন বুদ্ধিজীবী বা ফিল্মবোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছেন এমন হাস্যকর অভিযোগ এখনও কেউ করেননি।
যারা মুখ্যমন্ত্রীর কাট আউট বা ছবি নিয়ে জলঘোলা করছেন তাদের একটা কথা পরিষ্কার করে বলি, প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বাঁচেন একমাত্র তার কাজের সুবাদে। ডিমনিটাইজেশন থেকে শুরু করে কৃষকদের আত্মহত্যা, বৈধ নাগরিকদের দেশ থেকে তাড়ানো, আদিবাসী ভূমিপুত্রদের জমি থেকে উচ্ছেদ ইত্যাদি কুকর্মে মোদীর ভাবমূর্তি ইতিমধ্যেই বেশ মলিন। দেশের শ্রেষ্ঠ ফোটোগ্রাফার, ব্যয়বহুল আলোকচিত্র, সেরা বিজ্ঞাপন সংস্থার প্রচার কৌশল কোনটাই তার জনবিরোধী ভাবমূর্তিকে একটুও উজ্জ্বল করতে পারবে না। অন্যদিকে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী দক্ষ প্রশাসন ও জনমুখী কার্যক্রমের সুবাদে এ রাজ্যকে এমন একটা উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরও তার কাজের প্রশংসা করতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি বাংলার এই উৎসবকে কান ফিল্মোৎসবের উচ্চতায় তুলে নিয়ে যাবার কথা বলায় নিন্দুকরা মুখ বেঁকিয়ে হাসলেও সাধারণ মানুষ এটাকে মুখ্যমন্ত্রীর সংকল্প ও আত্মবিশ্বাস হিসেবেই দেখেছেন। নেতা বা নেত্রীর এই আত্মবিশ্বাসই মানুষের ভরসা বাড়ায়। তাদের কাজে উদ্বুদ্ধ করে। যে নেত্রীর এমন মানসিকতা তাকে তার নিজের প্রচারের জন্য কাট আউট বা ছবির উপর ভরসা করতে হয়না। চলচ্চিত্র উৎসবকে কেন্দ্র করে মুখ্যমন্ত্রীর এতাবৎকালের কাজই আপনাদের সমালোচনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে। আরও একটা কথা নিন্দুকদের জানিয়ে রাখি আগামী বছর যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের ২৫বর্ষ পূর্তির উৎসবে অংশগ্রহণ করবে প্রায় এক লাখ মানুষ। গুণে মানে ব্যপ্তিতে তা আগের সব উৎসবকে ছাড়িয়ে যাবে।
কোন প্রাচীন রেজিমেন্টেড পার্টির খুঁটির জোর বা রাজনৈতিক কৌশলে দলের জনপ্রিয় নেতাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে নয়, আমাদের দিদি আজকের জায়গায় উঠে এসেছেন নিজের লড়াই, ত্যাগ, নিষ্ঠা আর সাহস দিয়ে। কোন কাট আউট বা ছবিতে এ জিনিস ধরা যায় না। এসব কোন প্রচারের কম্মো নয়। বিবেকানন্দের ঢঙে পোজ দিলেই কি মোদী বিবেকানন্দ হবেন! শুধু কাট আউট বা ছবি দিয়েই কি কাউকে টিকিয়ে রাখা যায়!
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )