রামপ্রসাদ, কমলাকান্তের লেখা শ্যামাসঙ্গীতগুলি যার গলায় বড় বেশি করে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, তাঁর নাম পান্নালাল ভট্টাচার্য।
মাত্র ৩৬ বছরের জীবন ছিল পান্নালালের। ১৯৬৬তে অকালেই চলে যান তিনি। তবে এই সামান্য জীবনকালেই তিনি রেখে যান ‘সকলই তোমারই ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি’, ‘তুই নাকি মা দয়াময়ী’, ‘আমার মায়ের পায়ে জবা হয়ে ওঠনা ফুটে মন’-এর মত বহু শ্যামাসঙ্গীত, যা শুধু কথা, সুরে আর গায়কিতে সমৃদ্ধ নয়। যার মধ্যে আজও বাঙালি খুঁজে পায় প্রাণঢালা আকুতি, বুক উজাড় করা ভক্তি, আর নিঃশর্ত আত্মনিবেদন।
পান্নালাল আসলে তাঁর নিজের দাদা বিখ্যাত গায়ক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের আবিষ্কার। ভট্টাচার্য পরিবারে গানবাজনার রেওয়াজ কয়েক প্রজন্মের। দাদা আর ভাইয়ের তালিম সেখান থেকেই। প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ধনঞ্জয় তখন বাংলা-হিন্দি গানের পাশাপাশি ভক্তিগীতিও গাইতেন। কিন্তু কিছুদিন পর ধনঞ্জয় বুঝলেন, আগুন আছে পান্নার মধ্যে। তাই ১৭ বছরের পান্নাকে নিজে হাত ধরে নিয়ে গেলেন মেগাফোন কোম্পানির কাছে। সেখানেই তিনি বলেন, আমি নই, ভক্তিগীতিতে বাংলা মাতাতে পারে শুধু পান্নাই। এরপরই মেগাফোন ধনঞ্জয়ের কথায় রাজি হয়ে যায়। এবং তারপর বাকিটা ইতিহাস।
এর আগে কৃষ্ণচন্দ্র দে, ভবানী দাস, মৃণালকান্তি ঘোষ প্রমুখ শিল্পীরা ভক্তিগীতি গাইলেও পান্নালালের মতো আলোড়ন তুলতে পারেননি কেউই। যে জায়গাটা নিজেই করতে পারতেন ধনঞ্জয়, তা তিনি দিয়ে দিলেন ভাইকে। অথচ সুপারহিট ‘সাধক রামপ্রসাদ’ ছবিতে ২৪টির মধ্যে ২৩টি গানই গেয়েছিলেন ধনঞ্জয়। ‘রানী রাসমণি’-র গান গেয়ে পেয়েছিলেন স্বর্ণপদকও। কিন্তু তা সত্ত্বেও নির্লোভ শিল্পী বলতেন পান্না যা দিয়ে যাচ্ছে, তা দিয়ে বাঙালির কয়েকশো বছর চলে যাবে। আসলে ভাই পান্নালালকে সন্তানের চেয়ে বেশি ভালবাসতেন ধনঞ্জয়।
জীবনাবসানের ৫২ বছর পরেও তাই শ্যামাসঙ্গীতে অজেয়-অপরাজেয় থেকে যান ধনঞ্জয়-পান্নালাল। আজও বাঙালির ঘরে ঘরে কিংবা শ্যামাপুজো, কৌশিকী অমাবস্যা, রটন্তী কালী, পৌষ কালী, রক্ষা কালীর পুজোয় বেজে ওঠে পান্না-ধনের গান।