প্রবাসীর কলম:-
আমি তেত্রিশ বছর আমেরিকায় আছি। এমন ভয়াবহ সঙ্কট এদেশে কখনো দেখিনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬’র নভেম্বরে যখন নির্বাচিত হন, তখন আমি আনন্দবাজারে লিখেছিলাম, শেষ পর্যন্ত হিলারি ক্লিনটন ভোটে জিতবেন। আমার ভবিষ্যদ্বাণী নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে করা উচিত ছিল। কিন্তু, আমি তা না করে নিউ ইয়র্ক টাইমস, সি এন এন, এবং নানা লিবারাল মিডিয়ার জরিপের ওপর ভিত্তি করে করেছিলাম। তাদের জরিপ সাধারণ মানুষের কানাকানি, মাটির সঙ্গে লেগে থাকা প্রায় নিঃশব্দ ফিসফাস, এবং খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিলোনা। ট্রাম্পের নির্বাচন আমেরিকার এলিট ও লিবারাল ক্লাসের জন্যে এক চরম শকের মতো, বিপর্যয়ের মতো নেমে এসেছিলো।
আমি কিন্তু বিভিন্ন ডাইনার, রেস্টুরেন্ট, পাব এবং বিশেষ করে আমাদের নিজেদের শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর মধ্যে ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের প্রতি বিরাট সমর্থন লক্ষ্য করেছিলাম। ঠিক যেমন এখন এই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ নভেম্বর মাসের কংগ্রেসের নির্বাচনে আবার লক্ষ্য করছি।
আমি থাকি নিউ ইয়র্কে। লিবারালদের ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ঘাঁটি। এখানেই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে অন্য জায়গাগুলোতে কী অবস্থা, তা কল্পনা করে নিতে সমস্যা হয়না। ট্রাম্প ও তার দল যেখানে প্রকাশ্যেই শ্রমিক ইউনিয়নের ধ্বংস চায়, সেখানে ইউনিয়ন শ্রমিকরা কীকরে এবং কেন তাদের ভোট দেবে, তা আমার বুদ্ধির বাইরে। আমি তাদের সরাসরি জিজ্ঞেস করিনি। তারা আমার মতো লোকদের পছন্দ করেনা, এবং এড়িয়ে চলে। ঠিক ভারত বা পশ্চিমবাংলার মতোই ইন্টেলেকচুয়াল অথবা অ্যাকাডেমিক বা স্কলার-জাতীয় শব্দগুলো এখন আমেরিকার এক বিশাল জনসমষ্টির বিতৃষ্ণা ও ঘৃণার কারণ। আমরা তাদের বোঝাতে পারিনি, কী ভয়ঙ্কর বিপদ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের সকলের ওপর নেমে আসছে। আমাদের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা তাদের সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে।
গত দু বছরে ট্রাম্প ও তার রিপাবলিকান শাসকদের কাজের তালিকার ওপর যদি একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে এই জিনিসগুলো আমাদের নতুন করে ভাবতে সাহায্য করবে। (এক), বিশ্বায়িত ভয়াবহ উষ্ণায়ণ সম্পর্কে প্যারিসে যে ক্লাইমেট চুক্তি সারা বিশ্বের মানুষ ও বৈজ্ঞানিকরা পাশ করেছিলেন — যার স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন বারাক ওবামা, ট্রাম্প সরকার সে চুক্তি থেকে আমেরিকার নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে। (দুই), অতি সম্প্রতি রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে পাশ করানো পারমাণবিক শক্তি চুক্তি থেকে আমেরিকা নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে — নতুন এক সর্বগ্রাসী বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে। (তিন), এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সির (ই পি এ) মাথায় বসানো হয়েছে এমন এক ব্যক্তিকে, যিনি প্রকাশ্যে ই পি এ’কে অবলুপ্ত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। (চার), সারা আমেরিকাতে বলবৎ করার জন্যে “রাইট টু ওয়ার্ক” আইন পাশ হয়েছে, যার ফলে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সদস্য হবার পথে বিরাট বাধার সৃষ্টি হবে, এবং ইউনিয়নগুলো আরো দুর্বল হয়ে পড়বে (এখনই আমেরিকায় প্রতি একশোজন শ্রমিকের মধ্যে মাত্র দশজন ইউনিয়ন মেম্বার — জার্মানি, ইটালি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, সুইডেন বা বেলজিয়ামের তুলনায় তা নগণ্য)। (পাঁচ), অতি ধনী আমেরিকানদের জন্যে আরো বেশি কর হ্রাস করা হয়েছে, এবং তার ফলে সরকারের বাজেট ঘাটতি দুই ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি হয়ে পড়েছে। সে ঘাটতি পূরণ করার জন্যে এখন সবরকম বহুকালের জনহিতকর অর্থ তহবিলকে লুপ্ত করে দেওয়ার চক্রান্ত চলেছে। (ছয়), ট্রাম্পের নিজের ব্যক্তিগত চরিত্র আরো বেশি কালিমালিপ্ত হয়েছে পর্ণোগ্রাফি তারকাদের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে। (সাত), সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগে এমন এক ব্যক্তিকে ট্রাম্প সমর্থন দিয়েছে, যার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন মহিলা যৌন নির্যাতনের মামলা করেছেন। (আট), ট্রাম্প প্রকাশ্যে ইমিগ্রেন্ট ও মহিলাদের সম্পর্কে কুৎসিত কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে, এবং গোঁড়া জাতিবিদ্বেষী ও বর্ণবিদ্বেষীরা তা উল্লাসে সমর্থন করছে। (নয়), সাংবাদিকদের ওপর দৈহিক হামলা চালানো নির্বাচিত রিপাবলিকান নেতাদের ট্রাম্প প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছে। এবং (দশ), হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট বা শ্বেতাঙ্গ খ্রীষ্টান চরমপন্থী ব্যক্তিরা ট্রাম্পের চারদিকে উচ্চপদস্থ সরকারি পদে বহাল হয়েছে।
এছাড়া, গরিব ইমিগ্রেন্ট শিশুদের তাদের বাবামায়ের থেকে আলাদা করে খাঁচায় পুরে রাখা, ও বাবামাকে জোর করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া — এই ধরণের ঐতিহাসিক বর্বরতা চলেছে — যা আমি কোনোদিন দেখিনি। হিটলারের জার্মানিতে উত্থানের সঙ্গে অদ্ভুত সাদৃশ্য!
নতুন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মানো ইমিগ্রেন্ট বাবামায়ের সন্তানদের জন্মগত নাগরিকত্ব আর দেওয়া হবেনা। যা কিনা আমেরিকার সংবিধানবিরোধী।
এই হলো আমেরিকার অবস্থা। আমি রোনাল্ড রেগানের মতো অতি দক্ষিণপন্থি প্রেসিডেন্টের আমল থেকে আমেরিকায় আছি। জর্জ বুশের মতো যুদ্ধবাদী, মিথ্যাবাদী প্রেসিডেন্টের আমলে আমি রাস্তায় নেমে যুদ্ধ, বর্বরতা এবং ইমিগ্রেন্টদের ওপর হেট্ ক্রাইমের বিরুদ্ধে আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু, আজকে ট্রাম্প ও তার হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট দ্বারা পরিচালিত রিপাবলিকান পার্টির মতো এতো নিষ্ঠুর, এতো ভয়ানক, এবং এতো বেশি মানবসভ্যতাবিরোধী শাসকশ্রেণী আমি আগে কখনো দেখিনি।
এই সবকিছুর বিরুদ্ধেই নভেম্বর নির্বাচনে আমেরিকার মানুষ মার্কিন কংগ্রেসের নির্বাচনে ভোট দিতে চলেছেন। এর মধ্যে চারশো পঁয়ত্রিশজন আমাদের দেশের লোকসভার মতো হাউস অফ রিপ্রেসেন্টেটিভ (হাউস), এবং একশো জন সেনেটরের মধ্যে পঁয়ত্রিশজন এই নির্বাচনের মুখাপেক্ষী।
ডেমোক্র্যাটরা আশা করছে, তারা যেহেতু এখন হাউস এবং সেনেট দুজায়গাতেই সংখ্যালঘু, এই নির্বাচনে যদি তারা অনেক বেশি সীটে জয়লাভ করতে পারে, তাহলে কংগ্রেসের কর্তৃত্ব তাদের হাতে আসবে, এবং তখন তারা ট্রাম্পকে তার অসংখ্য জনবিরোধী এবং আইনবিরোধী কাজের জন্যে ইমপিচ করে পদচ্যুত করতে পারে। যেমন, সত্তরের দশকে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির জন্যে নিক্সনকে ইমপিচ করা হয়েছিল। কিন্তু, আমার সন্দেহ আছে, ডেমোক্র্যাটরা কিছু সীটে জিতলেও কংগ্রেসে যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেনা।
তার কারণ হলো এই। সারা আমেরিকায়, ঠিক আজকের ভারতবর্ষের মতোই এক একনায়কতন্ত্রের ও ফ্যাসিবাদের লক্ষণ দেখা দিয়েছে, এবং জঙ্গি হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট, কুখ্যাত কে কে কে, নিও নাৎজি, অল্ট রাইট — এইজাতীয় ভয়ঙ্কর ধর্মবিদ্বেষী, বর্ণবিদ্বেষী, জাতিবিদ্বেষী শক্তিগুলো মাটির তোলার অন্ধকার গর্ত থেকে একেবারেই দিনের আলোতে চলে এসেছে। তাদের পিছনে আছে অতি শক্তিশালী কোক ব্রাদার্স এবং তাদের হাজার কোটি ডলার। ওবামার মতো কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার সময়ে থেকেই এরা শপথ নিয়েছিল তীব্র, সশস্ত্র জঙ্গি প্রতিরোধ গড়ে তোলবার। ট্রাম্পের মতো প্রেসিডেন্ট এবং তার সহযোগী শাসকরা তাদের সে সুযোগ ত্বরান্বিত করে দিয়েছে। তারা এখন দিবালোকেই প্রতিশোধের অপেক্ষায়।
এই সেদিন পিটসবার্গের ইহুদি সিনাগগে এক হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট গুলি চালিয়ে এগারোজন নিরীহ জু’কে হত্যা করেছে। আর একজন হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট এই সেদিন এক সুপারমার্কেটে গুলি চালিয়ে দুজন নিরীহ কৃষ্ণাঙ্গকে খুন করেছে। আর এক হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট ওবামা, হিলারি, আরো অনেক ডেমোক্রেটিক নেতার বাড়িতে পোস্টাল বোমা পাঠিয়েছে এই সেদিন। তার ট্রাকের সারা গায়ে ট্রাম্পের স্টিকার লাগানো। সাংবাদিকদের ওপরে লাগাতার আক্রমণ চলেছে। প্রাগৈতিহাসিক দানবরা বহুকাল বন্ধ থাকার পর আদিমকালের বোতল থেকে ছাড়া পেয়ে গেছে। তারা সভ্যতাকে ধ্বংস করতে উদ্যত।
যদিও প্রতিরোধ চলেছে। কিন্তু ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে এখন বার্নি স্যান্ডার্স ছাড়া এমন কোনো নেতা নেই, যিনি সবাইকে একজায়গায় জড়ো করে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন। কিন্তু বার্নি স্যান্ডার্সকে হিলারি ক্লিন্টন বিল ক্লিন্টন-পন্থী মূলস্রোত ডেমোক্র্যাটরা সমর্থন করেনা, এবং তাদের বিশাল মিডিয়া নিউ ইয়র্ক টাইমস বা সি এন এন বা ওয়াশিংটন পোস্ট’ও করেনা। ফলে, শিক্ষিত, উদারনৈতিক, মুক্তমনা আমেরিকানদের যে জনরোষ ছয়ই নভেম্বরের ব্যালট বাক্সে আছড়ে পড়তে পারতো, তা কতটা সফল হবে, এ বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে আমেরিকার আজকের পরিস্থিতির দারুণ মিল!
আমি অবশ্য চাইবো, কিছু কিছু ল্যান্ডমার্ক আসনে ডেমোক্র্যাটরা যেন জেতে। এই প্রার্থনা আমি করছি। যেমন, জর্জিয়ার গভর্ণর নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গ নেত্রী স্টেসি অ্যাব্রামস জয়লাভ করলে তা হবে আমেরিকার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় — কারণ দক্ষিণের অতি রক্ষণশীল রাজ্যগুলোতে কৃষ্ণাঙ্গরা চিরকালই অনেক বেশি দলিত হয়েছে সেই দাসপ্রথার সময়ে থেকে। স্টেসি অ্যাব্রামস এই কয়েক বছর আগেই আমাদের শ্রমিক ইউনিয়নে দারুণ বক্তৃতা দিয়ে গেছেন। আমি চাইবো, টেক্সাসের সেনেট নির্বাচনে টেড ক্রুজের বিরুদ্ধে বেটো ও’রুর্কি যেন জয়লাভ করেন। টেক্সাস আর এক অতি রক্ষণশীল ট্রাম্প বেল্ট, শ্বেতাঙ্গ ও খৃষ্টান আধিপত্যবাদের জায়গা।
ট্রাম্প কেবলমাত্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নয়। সে আমেরিকার মতো একটা দেশের প্রেসিডেন্ট, যে দেশ চাইলে সারা পৃথিবীকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে লুপ্ত করে দিতে পারে। তাদের হাতে পৃথিবীর সব অস্ত্রের সিংহভাগ। তাদের হাতে শেষ মারণাস্ত্র পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র। তাদের বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো সারা পৃথিবীতে ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। সেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যদি উন্মাদ ও নিষ্ঠুর হয়, তাহলে পৃথিবীর ধ্বংস সমাসন্ন।
আমার গুরু নোম চমস্কিও বার বার করে নিউক্লিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও ক্লাইমেট চেঞ্জ — এই দুই চরম ধ্বংসের সম্পর্কে মানবজাতিকে সাবধান করে দিয়ে চলেছেন। আমেরিকানরা অধিকাংশই চমস্কির নাম কখনো শোনেনি। “জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই” — এই প্রবাদবাক্য এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মগজকে সম্পূর্ণ অধিকার করে ফেলেছে। ঠিক আমাদের দেশের মতোই।
এই যুগকে আমি নাম দিয়েছি দ্য এরা অফ পোস্ট রীজন। অর্থাৎ, যে যুগে প্রশ্ন, বিতর্ক, বিশ্লেষণ অতীত ইতিহাস। এখন “মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে।”
এই অন্ধকার যুগ — অন্তত এই আমেরিকায় — নভেম্বর নির্বাচনে কি শেষ হবে? আমার নিজের বিশ্বাস হয়না। কিন্তু আশা রাখবো, মানুষ আমাকে ভুল প্রমাণিত করবে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )
ডঃ পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
(নিউ ইয়র্কে মানবাধিকার কর্মী, লেখক ও শ্রমিক শিক্ষক)