সত্যবতী, সত্যান্বেষী, সত্যকাম- সত্য দিয়েই ‘গোত্র’-রক্ষা করল অরিন্দম শীলের ‘ব্যোমকেশ গোত্র’। প্রায় প্রত্যেকেই এতদিনে জেনে ফেলেছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রক্তের দাগ’ গল্পটি নিয়েই অরিন্দম বানিয়েছেন এবারের ব্যোমকেশ। তিনি এমনভাবেই তাঁর ছবির চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন বহুবার পড়া চেনা গল্পও মাঝেমাঝে অচেনা ঠেকেছে। দানা বেঁধেছে রহস্য।
সত্যকাম(অর্জুন চক্রবর্তী) অসচ্চরিত্র। তবে মহিলা মহলে সে বিশেষ জনপ্রিয়। এর কারণ তাঁর যৌন আবেদন। তবে একইসঙ্গে দুঃসাহসীও বটে। কোনও মহিলার প্রতি আসক্ত হওয়ার পর তার দাদা, বাবা হুমকি দিলে কিংবা তাঁদের ভাড়া করা গুণ্ডারা পেটাতে এলে সেও পাল্টা দিতে সক্ষম। কিন্তু তাঁর মনে হয় শীঘ্রই সে খুন হয়ে যাবে। তবে তাঁকে কে, কেন খুন করতে চাইছে বা করবে তা তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়। তাই খুনের পরে যেন সত্যান্বেষণ হয় এবং অপরাধের কারণ ও অপরাধী কে তা জানা যায়, সেই আর্জি নিয়েই ব্যোমকেশ(আবির)-এর দ্বারস্থ হন সত্যকাম। এরপরই গল্পে ঘটতে থাকে একের পর এক চরিত্রের প্রবেশ।
যেমন রানাঘাট কুপার্স ক্যাম্পের চুমকি (সৌরসেনী) যে সত্যকামেরই পিসির বোন। কুমিল্লার ভাষাতেই কথা বলে। আর এমিলি (প্রিয়াঙ্কা), চার্চের আশ্রয়েই যাঁর বেড়ে ওঠা। জীবনধারণের জন্য সে ক্যাবারে নাচে। ভালোবাসে সত্যকামকে। অন্যদিকে, রয়েছে পুলিশকর্তা পুরন্দর পান্ডে(হর্ষ ছায়া) এবং তাঁর কন্যা মীরার(বিবৃতি) চরিত্র। এছাড়া রয়েছে প্রবীণ উষাপতি(অঞ্জন দত্ত) ও সুচিত্রা (বৈশাখী মার্জিত)। আর ব্যোমকেশের অভিন্নহৃদয় লেখকবন্ধু ‘নতুন’ অজিত(রাহুল) ও স্ত্রী সত্যবতী(সোহিনী) তো রয়েছেই।
ছান্দোগ্য উপনিষদে ছিল জবালাপুত্র সত্যকামের উত্তরণের গল্প। সে তার মা-র কাছে নিজের পিতৃপরিচয় জানতে চেয়েছিল। কিন্তু উত্তর পায়নি। আর, এই সিনেমায় ওমেনাইজার সত্যকামও মায়ের কাছে সেই একই প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়। ‘দুর্ভাগ্য’-বশত সেই উত্তরটা সে পেয়েও যায়। তবে উত্তরণের সুযোগটুকু পায় না সে। জোটে মৃত্যু। আর সেই মৃত্যুর কারণ খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে পড়ে দীর্ঘদিন ধরে চাপা পড়ে থাকা এক পারিবারিক ইতিহাস। সত্যান্বেষীর মুকুটে যুক্ত হয় আরও এক সত্যের পালক।
ছবির স্বার্থেই গল্পের ছাঁচটুকু মোটামুটি এক রেখে গোটা কাহিনীই খানিকটা নতুন করে বুনেছেন অরিন্দম। ২০১৮-য় দাঁড়িয়ে ১৯৫২-র কল্লোলিনী কলকাতাকে ধরা কঠিন বুঝেই ঘটনার পটভূমি বদলেছেন তিনি। সব দিক বিবেচনা করেই ৩৩ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রিট হয়ে গিয়েছে শৈলশহর মুসৌরি। কিন্তু তাতে ছিটেফোঁটাও সামঞ্জস্য নষ্ট হয়নি গল্পের। তবে আরেকটি কারণেও পরিচালক অরিন্দমের প্রশংসা প্রাপ্য। তিনি বেশ সাহসিকতার সঙ্গেই এই ছবিতে একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। চিত্রনাট্যে যেভাবে তিনি রহস্যটা সাজিয়েছেন, তাতে ছবির প্রথমাংশ জুড়ে ব্যোমকেশের ভূমিকা অনেকটাই স্থিতধী দর্শকের বা পর্যবেক্ষকের। এমনও হয় একটাসময় সে বুঝতে পারছে তার মক্কেল সত্যকাম মরবেই। খুন অনিবার্য। তবুও সে অপেক্ষা করতে থাকে খুনের, এক নতুন সত্যের মুখোমুখি হওয়ার আশায়। আবার দেশভাগের পরিস্থিতি, দাঙ্গা, রিফিউজি ক্যাম্পের যাতনা-ভরা ইতিহাস, বিপ্লবের প্রতীক্ষায় গোপনে প্রস্তুত হতে থাকা কিউবার রাষ্ট্রিক পরিবেশও বুদ্ধি করে ঢুকিয়ে দিয়েছেন চিত্রনাট্যে। যে কারণে আরও উপভোগ্য হয়ে ওঠে এ ছবি।
অভিনয়ের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় সত্যকামের ভূমিকায় অভিনয় করা অর্জুন চক্রবর্তীর কথা। তাঁর অসাধারণ অভিনয় নিঃসন্দেহে এ ছবির সম্পদ। পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন ব্যোমকেশ আবিরও। তবে কিছু কিছু দৃশ্যে তাঁকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন অর্জুন। আবার ‘নতুন’ অজিত হিসাবে রাহুলও মন্দ নন। তবে অরিন্দমের এর আগের ব্যোমকেশগুলি যাঁরা দেখেছেন, ঋত্বিক চক্রবর্তীর অজিতকে মিস করবেন তাঁরা প্রত্যেকেই। সত্যবতীর ভূমিকায় সোহিনী সরকারের অভিনয়ও বেশ সাবলীল। সোহিনীর মুখে সংকোচ, বিরক্তি, রাগ ও লজ্জার মত আলাদা আলাদা অভিব্যক্তিগুলি দেখে বেশ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। চুমকি ও এমিলির চরিত্রে নজর কেড়েছেন সৌরসেনী ও প্রিয়াঙ্কাও। ভাল লাগে অঞ্জন দত্তের অভিনয়ও। উষাপতির চরিত্রটিকে তিনি নিজের মত করে গড়ে নিয়েছেন।
মায়াবী মুসৌরির বুকে ভ্রমণপিপাসুর মতই ঘুরে বেড়িয়েছে শুভঙ্কর ভড়ের ক্যামেরা। তাঁর প্রতিটা ফ্রেমই কুয়াশামাখা, কেমন যেন মায়া লাগানো। চোখ জুড়িয়ে যায়। সংলাপ ভৌমিকের নিখুঁত এডিটিং ছবিটিকে মেদবর্জিত করেছে। ভাল লাগে বিক্রম ঘোষের সঙ্গীত এবং আবহও। হল থেকে বেরানোর পরেও কানে বাজে বৈশাখী মার্জিতের গাওয়া ঠুংরির অংশগুলো। তাই পুজোর ছুটি থাকতে থাকতেই একবার দেখে আসতে পারেন ব্যোমকেশ গোত্র। মুসৌরির মায়াবী পরিবেশে ব্যোমকেশের সঙ্গে খানিকটা সময় কেটে যাবে।