ভারতীয় আইনিব্যবস্থার ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল এবং যুগান্তকারী মামলা হল ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা। এমনকি পৃথিবীর যে কোনও দেশের যে কোনও প্রান্তের প্রতিটি আইনের ছাত্রকেই পড়তে হয় এই মামলার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। কারণ, একদিকে এ যেমন এক বিরল মামলা, তেমনি এই কাহিনী হার মানায় পৃথিবীর সেরা সেরা গোয়েন্দা গল্প বা রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজকেও।
গল্পের পটভূমি পূর্ববঙ্গের ভাওয়াল এস্টেট। ভাওয়ালের রাজারা ছিলেন বাংলার বারো ভুইঞাদের বংশধর। রাজবাড়ির মেজকুমার রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী, সে সময়ের জমিদারপুত্রদের মতই উশৃঙ্খল। তাঁর দিন কাটে কখনও জলসাঘরে বাইজি নাচ দেখে, কখনও বহু নারী সঙ্গে। আবার কখনও বা বাঘশিকার করে। এমন উশৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্যই ১৯০৫ সাল নাগাদ সিফিলিস আক্রান্ত হন তিনি। ১৯০৯ সালে চিকিৎসা কার্যে দার্জিলিং নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। আর সেখানেই মে মাসের ৭ তারিখে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা এস্টেটের অশ্বিনী ডাক্তার এবং রমেন্দ্র নারায়ণের শ্যালক সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়। বলা হয়, তাঁর মৃতদেহ দাহ করা হয় পরের দিন ৮ মে।
কিন্তু প্রায় দীর্ঘ ১২ বছর পর ভাওয়ালে আসেন এক নাগা সন্ন্যাসী। তাঁকে দেখতে হুবহু রমেন্দ্র নারায়ণের মতই। তাঁকে দেখেই মেজকুমারের বোন দাবি করে বসেন এই সন্ন্যাসীই তাঁর ‘মেজদা’, এস্টেটের মেজকুমার। এরপর একসময় সেই সন্ন্যাসীও মুখ খোলেন। তিনি জানান, তিনিই রমেন্দ্র কুমার। ভাগ্যচক্রে বেঁচে গিয়েছেন। তাঁকে চিতা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিলেন নাগা সন্ন্যাসীরা। তাঁকে হত্যা করে সম্পত্তি হাসিল করতে চেয়েছিলেন দুই ষড়যন্ত্রকারী। তাঁর স্ত্রী বিভাবতী ও শ্যালক সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপরই মামলা গড়ায় কোর্টে। মোটামুটি এই হল ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা। এবার আসা যাক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘এক যে ছিল রাজা’-র কথায়।
ভাওয়াল সন্ন্যাসী নিয়ে এ পার বাংলায় প্রথম ছবি করেছিলেন পরিচালক পীযূষ বসু। উত্তম-সুপ্রিয়া অভিনীত ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৫ সালে। তবে সেই ছবিটি ছিল পরিচালকের কল্পনাপ্রসূত। তিনি কখনওই দাবি করেননি যে তাঁর ছবিটি তথ্যমূলক বা সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা অবলম্বনে। এমনকি ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার জটিলতায় ঢোকার চেষ্টাই করেনি সেই ছবি। কিন্তু সৃজিত প্রথম থেকেই বলে আসছেন তাঁর ছবিটি ইতিহাস নির্ভর একটি ছবি। রীতিমত কেস স্টাডি করে আর পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা বিখ্যাত বই ‘দ্য প্রিন্সলি ইম্পোস্টার’ পড়েই তিনি এই ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন বলেই তাঁর দাবি। তাই এ ছবি কোনওভাবেই ‘সন্ন্যাসী রাজা’-র রিমেক নয় এবং ছবি দেখেও তা একবারের জন্যেও মনে হয়নি। তবে সমস্যা অন্য জায়গায়।
সৃজিত ছবির শুরুতেই জানিয়েছেন, দুই উকিলের (অপর্ণা সেন ও অঞ্জন দত্ত) চরিত্র ‘ফিকশনাল’ করা ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রেই তিনি সত্য আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সত্যিই কি সত্য উন্মোচিত হল? প্রথমত ছবিতে নামগুলোই পাল্টে দেওয়া হয়েছে। যেমন ছবিতে রমেন্দ্র নারায়ণ রায় হয়েছেন মহেন্দ্রকুমার চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী বিভাবতীদেবী হয়েছেন চন্দ্রাবতী। আবার বোন কৃপাময়ীর অনশনের দাবী হয়ে গিয়েছে আত্মহত্যার হুমকি। এখানেও পরিবর্তন!
অন্যদিকে, এই মামলা কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ, কেনই বা বিরল, এ ছবি দেখলে আদৌ তা বোঝা যায় না। এমনকি ছবিটি দেখলে কখনই মনে হয় না, কেসটি খুব জটিল ছিল। কারণ মেজকুমারের জীবন থেকে শুরু করে মামলা, সবক্ষেত্রেই সত্য বারবার চাপা পড়ে গিয়েছে ‘ফিকশন’-এর সমারোহে। সে সৃজিত যতই বলুন শুধুমাত্র দুই উকিলের ক্ষেত্রেই তিনি স্বাধীনতা নিয়েছেন। ফলে এ ছবির চিত্রনাট্য বাইরে থেকে রাজকীয় দেখালেও, ভিতর সেই সৃজিতসুলভ গিমিকেই ঠাসা।
কোর্টরুম ড্রামা বলতে যা বোঝায়, এ ছবি ঠিক তেমন নয়। ছবির শুরুতেই পরিচালক সৃজিত দেখিয়ে দিয়েছেন যে সন্ন্যাসীই আদতে রাজা। অপেক্ষা শুধুই কোর্টে প্রমাণিত হওয়ার। ফলে একমুহূর্তের জন্যেও দোটানায় পড়তে হয়নি দর্শকদের। মামলার জটিলতা নামমাত্রই, বরং কোর্টরুমে বেশি দেখা যায় দুই উকিলের সম্পর্কের জটিলতা এবং ওপরচালাকি। যা একেবারেই খাপ খায় না সেই সময়ের আদালত কক্ষে।
আবার মামলায় সাক্ষ্য, সওয়াল-জবাবের ধারা এতটাই সরলীকৃত যে প্রশ্ন জাগে, এই মামলা এতবছর ধরে চলেছিল কেন? ছবি দেখতে দেখতে দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগে, রাজার স্ত্রী কি স্বামীর মৃত্যুর ষড়যন্ত্রে সামিল ছিল? পরিচালক স্পষ্ট করেননি কিছুই। এসব দর্শকের কাছে অজ্ঞাতই রয়ে যায়। তবে বিরক্তি জাগে তখন, যখন ইংরেজি না জানা রাজা এবং তাঁর পরিবারবর্গ জজসাহেবের ইংরেজি ভাষায় দেওয়া রায় শুনে সঙ্গে সঙ্গে আবেগে কেঁপে ওঠে।
তবে এত ভুলভ্রান্তির মাঝেও প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য থাকে না। অভিনয় নিয়ে কথা বললে, প্রথমেই বলতে হয় যিশু সেনগুপ্তর কথা। যিশু এই ছবিতে অনবদ্য। মেজকুমার কিংবা নাগা সন্ন্যাসী, দু’রূপেই তাঁর অভিনয় লার্জার দ্যান লাইফ। নিজেকে ভেঙেচুরে নতুন নতুন চরিত্রে অভিনয় করতে তিনি যে বিশেষ পারদর্শী, তা আবারও প্রমাণ করলেন তিনি। জয়া এহেসান-ও স্বমহিমায়। বড়ই সাবলীল তাঁর অভিনয়। তবে এক্ষেত্রে তাঁর প্লাস পয়েন্ট, তিনি নিজেও একজন বাঙাল।
মেজকুমারের স্ত্রীয়ের চরিত্রে রাজনন্দিনী দত্তর অভিনয়ের পরিসর খুবই কম ছিল। ছবিতে তাঁকে খানিকটা যন্ত্রচালিতের মতই লাগে। দুই উকিল হিসেবে অসাধারণ অভিনয় করেছেন অঞ্জন দত্ত এবং অপর্ণা সেন। অশ্বিনী ডাক্তারের চরিত্রে রুদ্রনীল ঘোষের করার মত তেমন কিছুই ছিল না। তবে শ্যালকের ধূসর চরিত্রে কোথাও যেন ঠিক খুঁজে পাওয়া গেল না অসম্ভব প্রতিভাবান অভিনেতা অনিবার্ণ ভট্টাচার্যকে। এবার তাঁর ম্যানারিজমগুলো বড়ই একঘেয়ে ঠেকছে।
তবে এই ছবির সম্পদ গৈরিক সরকারের সিনেমাটোগ্রাফি। সাদাকালোয় যেমন মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি, তেমনই অসাধারণ রঙের ব্যবহারও করেছেন। জমিদার বাড়ির জলসাঘর থেকে বেনারসের ঘাট, পাহাড় থেকে মরুভূমি, প্রতিটি দৃশ্যের প্রতিটি শটই বড় যত্ন করে ধরেছেন তাঁর ক্যামেরায়। প্রণয় দাশগুপ্তর এডিটও যথাযথ। প্রশংসার দাবি রাখে সোমনাথ কুন্ডুর মেকআপও। তবে প্রোডাকশন ডিজাইন ও শিল্প নির্দেশনায় কিছু ত্রুটি চোখে পড়ে। ছবির মিউজিকও মন কেড়ে নেয়। বিশেষ করে শ্রেয়া ঘোষাল এবং ঈশান মিত্রর গলায় ‘এসো হে’ গানটি। যা গোটা ছবিজুড়েই বিভিন্ন দৃশ্যে বেজে ওঠে। ‘মহারাজ’ গানটির ব্যবহারও বেশ বুদ্ধিদীপ্ত।
তবে অভিনয়, সিনেম্যাটোগ্রাফি এবিং মিউজিক ভাল হলেও শেষরক্ষা হল না। ছবির চিত্রনাট্যই যেখানে দুর্বল আর গতিহীন, সেখানে দর্শকরা যে ‘বোর’ হবেন, তা বলাই বাহুল্য। সব শেষে বলা যায়, ইতিহাসনির্ভর ছবি বানাতে গিয়ে আবারও এক গিমিকসর্বস্ব ‘রাজকাহিনী’-ই বানিয়ে ফেললেন সৃজিত। যেখানে একশোভাগ গ্র্যাঞ্জার থাকলেও, তথ্য নেই বললেই চলে।
(সুব্রত বারিষওয়ালা)
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )