গঙ্গা বাঁচাতে গিয়ে গঙ্গাপ্রাপ্তি।
গঙ্গার দূষণমুক্তির দাবিতে অনশনে বসেছিলেন ৮৭ বছরের বৃদ্ধ জিডি আগরওয়াল। নদীর প্রাণ ফেরাতে একাই নেমেছিলেন আন্দোলনে। কিন্তু এই বয়সে ১১২ দিন অভুক্ত থাকার ধকল সহ্য হয়নি তাঁর। শেষমেশ ম্যারাথন অনশনের পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হল অধ্যাপক, পরিবেশবিদ জিডি আগরওয়ালের।
২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে ‘স্বচ্ছ গঙ্গা’র ধুয়ো তুলেছিলেন ‘হিন্দু-দরদী’ নরেন্দ্র মোদী। হিন্দুদের ‘মা’কে আবার আগের রূপে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। বারাণসীতে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে দাবি করেছিলেন, গঙ্গা মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে এসেছেন। ক্ষমতায় আসার পর আলাদাভাবে ‘নমামি গঙ্গা’ কর্মসূচিও শুরু করেন মোদী। কিন্তু, লাভ হয়নি। গঙ্গা দূষণের কোনও পরিবর্তন হয়নি। সুপ্রিম কোর্টও কেন্দ্র দুষে মত দিয়েছিল, এভাবে চলতে থাকলে কোনওদিনই গঙ্গা সাফ হবে না। ‘গঙ্গাপ্রেমী’ প্রধানমন্ত্রীকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছিলেন পরিবেশবিদ আগরওয়াল। কিন্তু তাঁর চিঠির কোনও জবাব আসেনি। প্রাক্তন আইআইটি পড়ুয়ার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজনও বোধ করেনি কেন্দ্রীয় সরকার। তবে মৃত্যুর পর শোকবার্তা জানিয়েছেন মোদী। লিখেছেন, ‘জেডি আগরওয়ালের প্রয়াণে শোকাহত। শিক্ষা, পরিবেশ বিশেষ করে গঙ্গা সাফাই নিয়ে তাঁর উৎসাহ স্মরণে থেকে যাবে’। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, পরিবেশবিদ বেঁচে থাকাকালীন প্রধানমন্ত্রী এটা স্মরণে আনলে কাজ হত।
কে এই জেডি আগরওয়াল? পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। নেশায়, পরিবেশবিদ। সন্ন্যাস নেওয়ার পর নাম হয় সন্ত জ্ঞানস্বরূপ সানন্দ। সন্ন্যাস নেওয়ার আগে কানপুর আইআইটি-র খ্যাতকীর্তি অধ্যাপক ছিলেন তিনি। বার্কলের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানে ডক্টরেট। এক সময় ভারতের জাতীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সদস্য-সম্পাদকও ছিলেন আগরওয়াল। কাজেই গঙ্গার দূষণমুক্তি নিয়ে আসলে যে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, পুরোটাই লোক-দেখানো, সেটা তাঁর থেকে ভাল আর কেউ বোঝেনি। না, কয়েকশো কোটি টাকা উড়িয়ে-পুড়িয়ে গঙ্গা-শোধনের সরকারি মোচ্ছবে তিনি শামিল হননি। বরং বেশ কিছু জরুরি ও প্রাসঙ্গিক দাবি তুলেছিলেন। যেমন গঙ্গার ওপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল, গঙ্গাবক্ষে অবৈধ খননের কাজ বন্ধ করা। সব মিলে ২২টি দাবি। কিন্তু সরকার তো দূর অস্ত, সাধারণ মানুষও জানতে পারেনি তাঁর প্রতিবাদ আন্দোলনের কথা। শেষপর্যন্ত একাই লড়ে গিয়েছেন। তবে লাগাতার ধকল শরীরে সহ্য হয়নি। ২০১০ সালেও ‘ন্যাশনাল রিভার গঙ্গা বেসিন অথরিটি’র সদস্য ছিলেন তিনি। ভাগীরথীর ওপর নাগপাল-প্রকল্পের বিরোধিতা করে আগেও ৩৮ দিন অনশনে বসেছিলেন অধ্যাপক। এবার হরিদ্বারের মাতৃসদন আশ্রমে গঙ্গা বাঁচানোর দাবিতে অনশনে বসেন। ২২ জুন থেকে অনশন শুরু করেছিলেন। প্রতিদিন সামান্য জল এবং মধু খেয়ে ৮৬ বছরের শরীরকে চাঙ্গা রাখছিলেন। কিন্তু গত মঙ্গলবার থেকে সেটাও বন্ধ করে দেন। ঘোষণা করেন, এবারের অনশন আমরণ অনশন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর শারীরিক অবস্থার এতটাই অবনতি হয় যে, উত্তরাখণ্ড সরকার একরকম জোর করেই তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যান হৃষীকেশের এইমস হাসপাতালে। বৃহস্পতিবার সেখানেই মারা যান সন্ত জ্ঞানস্বরূপ। যখন লড়াই করছিলেন, তখনও কেউ খোঁজ রাখেনি। ফিরে তাকায়নি সরকার। শেষটাও হলো সেই লোকচক্ষুর অন্তরালেই।
এরপর তো প্রশ্ন উঠবেই, ‘ও গঙ্গা তুমি বইছ কেন?’