মানুষের সাথে অন্য একটি মানুষকে বেঁধে রাখে মায়া। যে কোনও সম্পর্কেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমানুপাতিক ভাবে বাড়তে থাকে তা। দৃঢ় হয় তাঁর বাঁধন। আপাতদৃষ্টিতে অদৃশ্য এই বাঁধনে বাঁধা আমাদের বসুন্ধরা। পৃথিবীর বুকে যা কিছু ঘটে, যেখানে আছে প্রাণের স্পর্শ, যাকে ঘিরে মানুষের বিশ্বাস— সব কিছুই বাঁধা রয়েছে এই মায়ার বাঁধনে।
আসলে মায়ার বাঁধনে বাঁধা পড়েই দলবদ্ধভাবে বসবাস করে প্রাণীকুল। এই বাঁধনই টিকিয়ে রাখে সংসার। আবার একইসঙ্গে এ বাঁধন অনেকটা ফসকা গেরোর মত। সামান্য আলগা হলেই ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ে দীর্ঘদিনের সম্পর্কও।
আসলে যে বাঁধনেই বাঁধা পড়ুক মানুষ, জীবন তো আসলে একার। জীবনের দীর্ঘ সময় অতিক্রম করার পরই মানুষ উপলব্ধি করে এই বিষয়টি। আসলে এও এক খেলা। মায়ার খেলা। তবে এই মায়ার বাঁধনের মধ্যেও রয়েছে এক সৌন্দর্য। মানুষ আজীবন কাল ধরে উপলব্ধি করেছে তা। এই মায়াবন্ধনেরই মূর্ত স্বরূপ হলেন দশভুজা দুর্গা। তাঁর দশ হাত বিস্তৃত দশ দিগন্তে। মায়ার বাঁধনে তিনি বেঁধে রেখেছেন গোটা বিশ্বকে।
জগৎ সংসারের এই মায়ার বাঁধনই ৯৫ পল্লীতে ফুটে উঠেছে শিল্পী ভবতোষ সুতারের ভাবনায়। মানুষ সারা জীবনে যা উপার্জন করে, তার বৃহদাংশ সে সঞ্চয় করে। এই সঞ্চয় কিন্তু তার নিজের জন্য নয়। মায়ার বাঁধনে আটকে থাকা সংসারের অন্য সদস্যদের জন্যই এই সঞ্চয়। অনেকটা মৌমাছির মধু সংগ্রহের মতো বিষয়টি। ফুলে ফুলে ঘুরে মধু সংগ্রহ করে মৌচাকে সঞ্চয় করে মৌমাছির দল। কিন্তু শেষে সেই মধুর ভাগই পায় না তারা।
হাজার হাজার বাঁশ, বাবুই ঘাসের দড়ি আর রঙিন কাপড়ের বাঁধনে বেঁধে তৈরি মণ্ডপের মাথায় বিশালাকৃতির পাঁচটি মৌচাক স্থাপন করে দর্শকদের এই মায়ার বাঁধনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন শিল্পী। মৌচাকগুলি তৈরি হয়েছে ঘুঁটে দিয়ে।
মণ্ডপের শুরুতে ১২টা ইচ্ছাডানা অনবরত মেলে চলেছে তার পাখা। একই ছন্দে। খড়ের বাঁধনে বাঁধা দুর্গা নিজেও। বাছাই করা খড় বুনে তৈরি হয়েছে দেবীপ্রতিমা। তাঁর মুখ আর দশ হাত তৈরি হয়েছে কাগজের মন্ড দিয়ে। দুর্গার চুলের বেণী, পরনের শাড়ি, গয়না সব কিছুই তৈরি হয়েছে খড়ের বাঁধনে। প্রায় ৬ মাসের চেষ্টায় প্রতিমাটি তৈরি করেছেন ভবতোষ বাবু।
নাড়ি ছেদ হলেও, মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের ছেদ ঘটে না। এক মায়ার বাঁধনে আটকে থাকে সেই সম্পর্ক। মণ্ডপের মাঝের অংশ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রাণীর হৃদযন্ত্রের মতো অবিরাম দপদপ করে চলেছে। তার সঙ্গে যোগাযোগের নাড়িগুলো পৌঁছে গেছে দুর্গার গর্ভগৃহে। মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাভির বাঁধনের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে এই উপস্থাপনা।
তবে আলাদা করে কোনও আবহসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়নি মণ্ডপে। মণ্ডপের আনাচ-কানাচ থেকেই ভেসে আসছে ফাঁপা বাঁশ, হাঁড়ি, কলসির ওপর মৃদু আঘাতের মিশ্র শব্দ। যা শ্রুতিমধুর ঠেকবে মন্ডপে আগত দর্শনার্থীদের কানে। অন্তরে তৈরি করবে মায়া।
কলকাতার যে পুজোগুলি দেখার জন্য মানুষের ঢল নামে তার মধ্যে অন্যতম এই ৯৫ পল্লীর পুজো। যোধপুর পার্ক বাজারের কাছে রহিম ওস্তাগর লেনের এই পুজোটি মেয়র পারিষদ রতন দে-র পুজো হিসেবেই পরিচিত। এ বছর ৬৯ তম বর্ষে পদার্পণ করতে চলেছে তারা। আজ দেবীপক্ষে এই পুজো উদ্বোধন করবেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন মায়ার বাঁধনে বাঁধা পড়ার অপেক্ষায় শহরবাসী।