এই হারে কোনও লজ্জা নেই। বরং গর্ব হওয়া উচিত। এএফসি অনূর্ধ্ব ১৬ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের কোয়ার্টার ফাইনালে ভারত যে ফুটবল খেলেছে, তা এককথায় দারুণ। কোচ বিবিয়ানো ফার্নান্ডেজ আর তার দলকে অভিনন্দন। আমাদের ছেলেরা আক্রমণে যদি আর একটু লোক বাড়িয়ে খেলত, তা হলে এই দক্ষিণ কোরিয়াকে রুখে দিতে পারত। আমরা কোরিয়ার বড়দের দলটাকে দেখি। অনূর্ধ্ব ১৬ দলটাকে দেখিনি। দেখলাম। প্রথমার্ধে ওদের খেলা দেখে যত ভাল লেগেছিল, দ্বিতীয়ার্ধে ঠিক ততটাই একঘেয়ে লাগল। ডেথ ফুটবল খেলল! ব্যাক পাস খেলছে, খেলাটাকে মন্থর করে দিচ্ছে! এক, এক সময় ওদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন ৬ গোলে জিতছে, তাই আর কিছু দেখাতে চায় না। দুর্ভাগ্য, আরেকটু যদি সুযোগসন্ধানী হত আমাদের ছেলেরা, আক্রমণে আর একটু লোক বাড়াত, তা হলে জিতেই ফিরত ভারত। এটা নিয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।
যে কোরিয়ার এত নাম, সারা বিশ্বের সমীহ আদায় করে, তাদের সামনে কিন্তু আমাদের ছেলেরা এতটুকু হীনমন্যতায় ভোগেনি। এই যে মানসিকতা, এটাই তো চাই। বাইরে খেললে, বিশেষ করে ভাল টিমের সঙ্গে খেললে মানসিকতার বদল ঘটে। কথায় আছে সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস। আর অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। ভাল দলের সঙ্গে লড়লে উন্নতি হবেই। দু’বছর ধরে ভারতের অনূর্ধ্ব ১৬ দল যে দেশের মধ্যে, দেশের বাইরে গিয়ে খেলেছে, তাতে কম্বিনেশনটা তৈরি হয়েছে। এই পারফরমেন্স তরুণদের আরও বেশি উজ্জীবিত করবে। আমি স্যালুট করছি ভারতের প্রত্যেকটা ছেলেকে। গোলকিপার নীরজের তো কথাই নেই। আমার মতে ম্যাচের সেরা প্লেয়ার ওই–ই। গোটা দলে ডিফেন্স, মিডফিল্ড, অ্যাটাক— বোঝাপড়া ছিল। ডিমেলো তো লড়ে যাচ্ছিল। এই পরাজয়ের জন্য ভারতের অনভিজ্ঞতাকে দায়ী করব না। ফুটবলে অ্যাটাক না করতে পারলে যেমন দাম নেই, গোল করতে না পারলেও তাই। একটুখানি খামতি ছিল এই জায়গায়। দ্বিতীয়ার্ধের ৬৮ মিনিটে জিয়ং সান–বিনের গোলে পিছিয়ে পরার পরও ভারত দমে যায়নি। ভারতও অসাধারণ একটা সুযোগ পেয়েছিল। বিপক্ষের দুর্গে গিয়ে আমাদের ছেলেরা আক্রমণও করেছে। ভয়, সমীহ, কুঁকড়ে যাওয়া— এক মুহূর্তের জন্যও দেখিনি ভারতীয় ফুটবলারদের শরীরি ভাষায়। এই উজ্জীবিত ফুটবল যদি ধরে রাখা যায়, তা হলে ভারতীয় ফুটবলের জন্য সুখের খবর। যুব ফুটবলের উন্নতির কথা আমরা বলি। অনূর্ধ্ব ১৬ দল যেভাবে খেলছে, তাতে আরও যদি তালিম দেওয়া যায়, সময় দেওয়া যায় আগামী দিনে ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। হোম, অ্যাওয়ের ভিত্তিতে খেলতে হবে। বিদেশে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলাও দরকার। কোরিয়া, চীনের সঙ্গে খেলা দরকার। ওই সব মালদ্বীপ–টালদ্বীপের সঙ্গে খেলে কিছু হবে না।
প্রথমার্ধে দক্ষিণ কোরিয়ায় খেলায় আঁটসাট ব্যাপারটা ছিল। শুরুতে দক্ষিণ কোরিয়া একটা পাসের পরই লং পাস খেলতে শুরু করেছিল। ওই সময় ঘাবড়েই গেছিলাম দেখে। ভাবলাম, কোরিয়া তো লং পাসে খেলে না। তা হলে কেন খেলছে? হতে পারে এটা ওদের কোচের কৌশল। কোরিয়ার প্লেয়ারদের এমনিতেই গতি আছে। সেই সঙ্গে লং পাস খেলার অর্থ ভারতকে বিভ্রান্ত করা। প্রথমার্ধে দক্ষিণ কোরিয়ারই দাপট ছিল সব অর্থে। ওয়ান, টু, থ্রি— একের পর এক পাস খেলেছে! তবে যেটা বলার, অনেক চান্স, কর্নার পেয়েও গোলমুখটা খুলতে পারেনি প্রথমার্ধে। সুন্দর মুভ করে এগিয়ে গিয়ে যে গোল করা, সেটার অভাব ছিল। ফুটবল সম্পূর্ণ হয় গোলে। ওরা বল ধরছে, খেলছে, মারছে। কিন্তু ফিনিশটা হচ্ছিল না। প্রথমার্ধে কোরিয়ার হং, পার্ক, চোই অস্বাভাবিক ভাল খেলেছে। মাঠে বল রেখে গড়ানো পাস খেলেছে। কোরিয়ার ফুটবলে যেটা অনেকদিন দেখা যায়নি। কোরিয়ার ফুটবল মানে গতির ফুটবল। কিন্তু গ্রাউন্ড পাস খেলতে ওদের আগে দেখিনি। ওদের খেলার এই বদলটা লক্ষ্যণীয়। তবে দ্বিতীয়ার্ধে একদম একঘেয়ে ফুটবল খেলে ফেলল ওরা! এত ব্যাক পাস! এই ধরনের একঘেয়ে খেলা দেখার জন্য আমরা বসে থাকি না। হয়ত আমাদের ফুটবলাররাই ওদের সে সুযোগ দেয়নি। আসল কথা, চেষ্টা ছিল আমাদের ছেলেদের খেলায়। বিশেষ করে রবি রানার। দারুণ লাগল ওকে। ডিমেলো, বিক্রম প্রতাপ, গিবসনও দারুণ। ডিফেন্সে গুরকিরত সিং, থৈবাও অসাধারণ খেলেছে। দক্ষিণ কোরিয়া নিয়ে যে ধারণা আছে, তা ওদের খেলায় কিন্তু পুরোপুরি প্রমাণ হয়নি। কর্নার শট অত্যন্ত সাধারণ মানের। ওদের যে গোল, সেটাও আহামরি নয়। পার্ট অফ দ্য গেম বলা যায়। প্রায় বাঁচিয়েই তো দিয়েছিল আমাদের গোলকিপার নীরজ। হাত ফস্কে বেরিয়ে গেছে। হয়ত অভিজ্ঞতার জোরে কোরিয়া বেরিয়ে গেছে। তবে গোল খাওয়ায়, হারায় ভারত তলানিতে চলে গেল— একথা বলব না।
কোয়ার্টার ফাইনালের আগে কেন ভারত গোল খায়নি, গোলকিপার নীরজ কুমারকে দেখে প্রথমার্ধে বারবার বোঝা যাচ্ছিল। প্রথমার্ধের খেলায় ভারতকে বাঁচিয়ে রেখেছিল তো ওই। প্রথমার্ধে নীরজ যে শটটা বাঁচিয়েছিল, সেটা পজিটিভ গোল ছিল। নীরজের জন্যই গোলটা পায়নি কোরিয়া। ও যে দলের কত বড় ভরসা বুঝিয়ে দিচ্ছিল। দ্বিতীয়ার্ধে গোল খেলেও চেষ্টায় খামতি রাখেনি।
বয়সভিত্তিক ফুটবলে এখন ইতিবাচক মানসিকতার ছাপ স্পষ্ট। অনূর্ধ্ব ২০ দল এর আগে আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছে, অনূর্ধ্ব ১৬ দল আটকে দিয়েছে ইরাককে! এবার দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে এমন দুর্ধর্ষ খেলল অনূর্ধ্ব ১৬ দল। সোমবার জিতলে নিঃসন্দেহে ইতিহাস হত। অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপের টিকিট পেত। হয়নি। তবে এমন হার থেকেই জেতার রাস্তাটা খুঁজে পাওয়া যায়। বোঝা যাচ্ছে, টিমটা ঠিক পথে এগোচ্ছে। যথেষ্ট যোগ্যতা অর্জন করেছে। প্রমাণ হচ্ছে, আমাদের দেশে প্রতিভার অভাব নেই। ঠিকঠাক তালিম নিলে আরও ভাল করবে। আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। \
(সংগৃহীত)