ঘড়িতে তখন প্রায় বিকেল চারটা। কান খাড়া করে বসে আছি, কখন বাজবে ছুটির ঘন্টা। শেষ ক্লাস, আর তর সইছে না। ঘন্টা বাজতেই সাইকেল নিয়ে ছুট! অদ্ভুত আনন্দ! বাড়িতে আজ মাংস হয়েছে। সময়টা স্কুল জীবনের। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের বাড়িতে বছরে ৭-৮ বার কিছু বাঁধা দিনে মাংস হতো, বাকি সময়ে কোনো আত্মীয়-স্বজন এলে হতো। মানে নবমী, ভাই ফোঁটা, পয়লা জানুয়ারী, দোল, পয়লা বৈশাখ, জামাই ষষ্ঠী এমন কটা দিনে গ্রামের পাড়াগুলো মাংসের গন্ধে ম ম করত। আর চাষের মরশুম শেষ হলে একদিন গুছিয়ে মাংস ভাত। যারা ক্ষেতমজুর, কাজ করত চাষে, সবাইকে নেমতন্ন করে মাংস খাওয়ানো হতো। আনন্দে ধরত না সেদিনগুলো! ঘরে যেন উৎসব!
মাংসের থেকে মাছ অনেক বেশি হতো। আর বর্ষায় নানা জায়গায় জাল ফেলে অনেক মাছও পেত লোকে। অনেকে ছিপ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা মাছ ধরত। আমার দাদু বিখ্যাত মাছ ধরিয়ে ছিল। মুন্ডেশ্বরী নদীর ধারেই তার বেশিরভাগ দিন কাটত। কত বড় বড় মাছ ধরত দাদু। বড় বড় বোয়াল, রুই, কাতলা! আর বন্যার সময় তো এত মাছ, মাছ ভাজার তেল থাকত না। এটা অনেকেই জানে, তেলের অভাবে অনেকে বন্যার সময় মাছ সেদ্ধ করে রাখত কেউ কেউ, পরে সম্ভব হলে তেল কিনে ভাজবে বলে। আমি দাদুকে কম দিন দেখেছি জীবনে, কিন্তু অনেক মাছের ছবি আজও স্মৃতিতে জীবন্ত।
আমার বাবা মাংস ভালোবাসত। এখন মাছ ছাড়া ভাত খেতে পারে না। আমি মাছ ও মাংস দুটোই ভালোবাসি। সেই ছোটো বেলায় মাংস দেখলে যেমন জিভ দিয়ে জল বেরত, এখনও তাই। প্রায় প্রতিদিন খাই, বিরাম নেই। মাছ-মাংস ছাড়া মুখে ভাত ওঠে না। আমার নানান ধরণের মাছ খেতে ভালো লাগে।
আমার মেয়ে, বয়স ২ বছরেরও একটু কম। মাছ-মাংস ছাড়া কোনো মতেই ভাত মুখে তোলে না। আমি বাড়ি গেলে আমার সাথে মাছ-মাংস কিনতে বেরিয়ে পড়ে সকাল হলেই। বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে নিজেই প্রস্তুত হয়ে যায়। লোকে জিজ্ঞেস করলেই বলে, “আমি মাংস কিনতে যাবো, আমি জিজি কিনতে যাবো”।
এই হল আমাদের পরিবারের পরম্পরা! অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব প্রজন্মের রক্তেই মাছ-মাংসের প্রতি ভালোবাসা। এটা শুধু আমাদের বাড়ির কথা না, এটা অধিকাংশ বাঙালি বাড়িরই গল্প। সাধে কি বলে, মাছ ভাতে বাঙালি। সকাল সকাল কেউ মাছের বাজারে গেলেই বাকিটা নিজেরাই বুঝে যাবে। মাছ বাজারের স্পন্দন আসলে বাংলার হৃৎস্পন্দন। এ রাজ্যের ৯৮.৬ শতাংশ মানুষ আমিষাশী। কেউ কেউ নিরামিষ খান, খেতেই পারেন, ব্যক্তি স্বাধীনতা। কিন্তু কেউ নিজের আমিষ বা নিরামিষ কোনোটাই অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে পারে না, চাপিয়ে দিলেই সংঘাত অনিবার্য।
আজকাল ভারতে অদ্ভুত পরিস্থিতি, এমনকি বাদ নেই বাংলাও। অনেক স্কুলেই আমিষ নিষিদ্ধ, এগুলো গত কয়েক বছরেই হয়েছে। লজ্জার কথা, বাংলার বেশ কিছু হাসপাতালে এ দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, যেখানে হাসপাতালে চত্বরে আমিষের প্রবেশ নিষেধ। এমনকি হাসপাতাল নিযুক্ত ডায়েটেশিয়ান নিরামিষ খাবার প্রেসক্রাইব করছেন। রোগীকে আমিষ পথ্য থেকে জোর করে বঞ্চিত করা হচ্ছে। জল এতদূর গড়াচ্ছে যে, আমিষ খেলে কিছু আবাসনে ফ্ল্যাট ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, কেনা তো নয়ই।
ভারতের সরকারি সব বিমানে আমিষ খাবারের কোনো স্থান নেই, সবটাই নিরামিষ। কেন্দ্র সরকারের আয়ুস বিভাগ, মানে আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথি ইত্যাদি নিয়ে যে বিভাগ আছে, তাদের একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল কয়েকমাস আগে। বিজ্ঞাপনে দুটো মহিলার ছবি আঁকা ছিল। একজনের ছিল সুন্দর স্লিম ফিগার, তাঁর শরীর জুড়ে আঁকা ছিল নানা নিরামিষ খাবারের ছবি। আর একটা ছিল একটু মোটা মহিলার ছবি, তাঁর শরীরের সব জায়গায় ছিল আমিষ খাবারের ছবি। অর্থাৎ সুন্দর ফিগার চাইলে নিরামিষই একমাত্র পথ, আমিষ খেলে সুস্থ থাকে না মানুষ। এই বার্তা দেওয়া হয়েছে। ভাবুন, গভীরে গিয়ে ভাবুন। নিরামিষাশী হওয়া শুধুই কি খাদ্যাভ্যাস না মতাদর্শ, যা আধিপত্যবাদী।
আজ ২ রা অক্টোবর গান্ধীজীর জন্মদিনে “নিরামিষ দিবস” পালন করবে রেল, রেলের কোনো প্যান্ট্রি কার থেকে আজ পাওয়া যাবে না আমিষ পদ। এর অর্থ, আজ সবাইকে বাধ্যতামূলক আমিষ খেতে হবে। উল্টোটা হয়নি তো কোনোদিন, কাউকে জোর করে আমিষ খাওয়াচ্ছে রেল এখবর শোনা অসম্ভব। নিরামিষাশীরা জোর করে মানুষকে নিরামিষ খাওয়ায়, কিন্তু উল্টোটার খবর তো তেমন শোনা যায় না। আবারও বলছি, ভাবুন, ভাবা দরকার। নিরামিষাশী হওয়া কি শুধুই খাদ্যাভ্যাস? একটু তলিয়ে ভাবলেই সব দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে। কোন কোন রাজ্যে নিরামিষ বেশি চলে? একবার দেখা যাক। গুজরাট, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং হরিয়ানায় নিরামিষাশীরা সংখ্যাগুরু, অনেক জায়গায় ৪০% র কম আমিষাশী। প্রায় পুরো উত্তর ও পশ্চিম ভারতে একই পরিস্থিতি। সমাজের কোন অংশ খায় নিরামিষ? উত্তর দেওয়ার দরকার আছে? এর সাথে রাজনৈতিক দলের যোগ পাচ্ছেন? রাজ্যগুলো খেয়াল করুন। কোন দলের কোর ভোটার বেস বেশি সেখানে? সুতরাং বুঝতে পারছেন, নিরামিষাশী হওয়া একটা রাজনৈতিক মতাদর্শও।
বাঙালি মাছ-ভাতে বাঁচে, বাঙালির মাছ-ভাত কেউ কাড়তে পারবে না। বাঙালি যতদিন আছে ততদিন মাছ-মাংস ভাতে বাঁচবে। সকাল সকাল মাছের বাজারে ভিড় ও কলতান কেউ কমাতে পারবে না। আমাদের পরিবার বুঝলেন তো! দাদু বিখ্যাত মাছ ধরিয়ে ছিল, আর আমার মেয়ে মাছ-মাংস ছাড়া খায়না। বেশিরভাগ বাড়িরই একই পরিস্থিতি। তাই, কেউ জোর করে নিরামিষ চাপালে লড়াই রাস্তায় নেমেই হবে। কে কি খাবে সেটা তার ব্যক্তি স্বাধীনতা, আধিপত্যবাদ দেখলেই বাঙালি হিসাব বুঝে নেবে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )